》টি ব্যাগের চা: এক কাপ বিষ!
.
এক কাপ চা’ নিয়ে আমাদের কত কথা, কত আবেগ, কত অভিজ্ঞতা!
দার্শনিক কিংবা কবি এক কাপ চায়ে খুঁজে পেতে পারে জীবনের জয়ধ্বনি, অবরুদ্ধ আবেগ, অনাবিল অনুভূতি, মুক্তির আনন্দ কিংবা উল্লাস। এমনকী গণতন্ত্রও।
কিন্তু সেই চায়ের সঙ্গে আছে বিষও। প্লাস্টিকের বিষ। আমেজটা বেশি, নাকি বিষের পরিমাণটা, সে নিয়ে তর্কও চলতে পারে দীর্ঘকাল। তবে চা-প্রিয় মানুষ যে খবরটা শুনে আঁতকে উঠবে, সে কথা বলাই বাহুল্য। তাই বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখতে হয়। এখানে অবশ্য টি-ব্যাগের সাহায্যে তৈরি করা চায়ের কথাই বলা হচ্ছে।
এই জিনিসটি আবিষ্কার হয়েছিল মাত্র দেড় দশক আগে। চা পানের ক্ষেত্রে এই নাইলনের টি-ব্যাগ এক ‘নীরব বিপ্লব’ হয়ে এসেছিল। এ এক ছিমছাম চা তৈরির পদ্ধতি। পড়ে থাকা চা-পাতা পরিষ্কারের কোনও ঝঞ্ঝাট নেই। হোটেলে রেস্তোরাঁয়, অধিকাংশ টি শপ আর কফি শপে চা তৈরি করা হয় এভাবেই। আজকাল অনেক পাড়ার চায়ের দোকানেও চা তৈরি হয় টি-ব্যাগ গরম পানি বা দুধে ডুবিয়ে। এমনকি অনেক বাড়িতেও আজ তা একেবারেই স্বাভাবিক সাধারণ এক ঝঞ্ঝাট-বিহীন প্রকরণ। লক্ষ করলে দেখা যাবে, একটু ভালো টি-ব্যাগ তৈরি করতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাইলন বা প্লাস্টিকের ব্যবহার করা হয়েছে। টি ব্যাগ গরম পানিতে ডুবিয়ে চা পান করতে পছন্দ অনেকের। দিন দিন খোলা পাতি ব্যবহারের পরিবর্তে টি ব্যাগ ব্যবহারের মাত্রাও বাড়ছে। একইসঙ্গে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছি আমরা।
কারণ একটি টি ব্যাগ গরম পানিতে ডুবালে তাতে যোগ হয় ১১০০ কোটি প্লাস্টিক কণা! আমরা সকলেই জানি টি-ব্যাগ কাগজের তৈরি। তবে চায়ের সঙ্গে প্লাস্টিক শরীরে যাচ্ছে কীভাবে?
কিন্তু সকলেই যা জানি না তা হলো, টি-ব্যাগ কাগজের তৈরি হলেও সেটি সিল করা হয় পলিপ্রোপাইলিন দিয়ে। এই পলিপ্রোপাইলিন এক ধরনের প্লাস্টিক। গবেষকরা বলছেন, ফুটন্ত পানিতে প্লাস্টিক লাগানো কোনো জিনিস ডুবিয়ে সেটা পান করা অত্যন্ত ক্ষতিকর। ওই প্লাস্টিকের ব্যাগগুলি পানীয়ের মধ্যে অসংখ্য প্লাসটিকের কণা যোগ করছে এবং এগুলো মানব শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতকির।
কানাডার ম্যাগগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের মতে, একটি টি ব্যাগই ১১ বিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং ৩ বিলিয়ন ন্যানোপ্লাস্টিক কণা ছড়ায়। সাধারণ চোখে ওই দূষণ দেখা যায় না। ৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের গরম পানিতে ৫ মিনিট টি ব্যাগ ডুবিয়ে রাখলে গোটা চা-টাই প্লাস্টিকের পার্টিক্যালে ভরে যাচ্ছে। অর্থাৎ এক কাপ চা খাওয়া প্লাস্টিক খাওয়ার সামিল।
হিসেব বলছে, রোজ এক কাপ করে প্লাস্টিকের টি ব্যাগ ডোবানো চা খেলে, সপ্তাহে ৫ গ্রাম প্লাস্টিক পেটে ঢুকছে।
তাদের এই গবেষণার বিস্তারিত বিবরণ সম্প্রতি আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি জার্নাল এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, বেশ কিছু চা বিক্রয়কারী কাগজের টি ব্যাগের পরিবর্তে প্লাস্টিকের টি ব্যাগে চা বিক্রি করছেন। এ বিষয়ে জনসাধারণকেই সচেতন হতে হবে। তারা জানেন কীভাবে প্লাস্টিক আমাদের শরীরের এবং সমগ্র প্রকৃতির ক্ষতি করছে। এই টি ব্যাগে ব্যবহৃত প্লাস্টিক গ্রহণের ফলে স্বাস্থ্যের প্রভাবগুলি এখনও যদিও অজানা তবু এটা নিশ্চিত যে এগুলি যথেষ্ট ক্ষতিকারক।
বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষ অজান্তেই প্রচুর পরিমাণে টি ব্যাগ ব্যবহার করে চা পান করেন। তাই গবেষকদের পরামর্শ, দোকান থেকে টি ব্যাগ কেনার আগে যাচাই করে নিন সেগুলি প্লাস্টিকের তৈরি নাকি কাগজের তৈরি! কাগজের তৈরি হলে তবেই সেই টি ব্যাগ কিনুন, নিজের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য প্লাস্টিক বর্জন করুন। চায়ের কাপে প্লাস্টিকের টুকরোর পরিমাণ কিন্তু অন্য খাদ্যে পাওয়া প্লাস্টিকের টুকরোর চাইতে অনেক বেশি। প্লাস্টিকজাত অন্যসব পণ্যেও ক্ষতিকর উপাদানের অস্তিত্ব রয়েছে।
যেমন, গত বছরই নিউ ইয়র্কের স্টেট ইউনিভার্সিটির এক গবেষকের গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, পৃথিবীর সব বোতলজাত পানির ৯০ শতাংশেই হয় মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণ। একবার ব্যবহার-যোগ্য প্লাস্টিকের বোতলের এক লিটার পানিতে থাকে কোথাও ৪৪টি, কোথাও ৩২৫টি মাইক্রোপ্লাস্টিকের টুকরো।
প্লাস্টিক নিয়ে পৃথিবীর বহু দেশে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে। কারণ প্লাস্টিক আধুনিক জীবনকে অনেকটাই গ্রাস করে ফেলেছে। প্লাস্টিক সামগ্রী গোটা পৃথিবীর দূষণের প্রধান কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
সমুদ্রের গভীরে পর্যন্ত প্লাস্টিক সামগ্রী পৌঁছে গেছে। চিংড়ি, মাছ, ঝিনুকের মধ্যেও প্লাস্টিকের ক্ষতিকর উপাদানের অস্তিত্ব মিলছে। একটা ঝিনুকের মধ্যে থাকে ৯০টি প্লাস্টিকের টুকরো।
এমনকী এক কিলোগ্রাম লবণের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকছে ৬০০টি, যার সম্মিলিত ওজন এক মাইক্রোগ্রামের অর্ধেক।
আবার আমাদের খাবারে যে ধুলিকণা পড়ে, তা থেকেও বছরে ৭০ হাজার প্লাস্টিকের টুকরো ঢোকে আমাদের শরীরে।
কিন্তু এই সমস্ত হিসেবকে যেন ছাপিয়ে উঠেছে আমাদের বড় আমেজের ধোঁয়া-ওঠা এক কাপ চা। আসলে প্লাস্টিক বোধহয় মানুষের এক বিষাক্ত প্রেম- কথা। প্লাস্টিক আমাদের সভ্যতার মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি, আর তার ফলশ্রুতিতে এক ভয়াবহ দূষণের সম্মিলিত গল্প। আমাদের প্লাস্টিক-নির্ভরতা বর্তমানে চরম আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহারের কারণে এর ছোট্ট ছোট্ট কণা খাবার, পানীয়, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্য দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের শরীরের একদম গভীরে।
আজ প্লাস্টিকের দূষণ নিয়ে আমরা ভেবে চলেছি, আলোচনা করে চলেছি সভায়, আড্ডায়, সংবাদপত্রে, টিভিতে। কিন্তু ঠিক এতটা আমরা আদৌ এতদিন বুঝে উঠতে পেরেছি কিনা সন্দেহ। আমাদের শরীরে ঢুকছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, যা জমে জমে বিষাক্ত হয়ে উঠছে শরীরের বিভিন্ন অঞ্চল।
‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ শীর্ষক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, প্রতি বছর আমাদের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢোকে ৩৯ থেকে ৫২ হাজার। নিশ্বাসের প্লাস্টিক ধরলে সংখ্যাটা ৭৪ হাজারের বেশি। আজকের পৃথিবীর মানুষরা গড়ে প্রতি সপ্তাহে ৫ গ্রাম মাইক্রোস্কোপিক প্লাস্টিকের কণা খেয়ে চলে, যার ওজন মোটামুটি একটা ক্রেডিট কার্ডের ওজনের সমতুল্য। বছর জুড়ে এর সম্মিলিত পরিমাণ প্রায় ২৬০ গ্রাম। আমরা কি কখনও ভেবেছি, এতটা পরিমাণ প্লাস্টিক ঢুকছে আমাদের প্রত্যেকের শরীরে?
স্বাস্থ্যের উপর এই প্লাস্টিকের কী প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে, তার যথাযথ মূল্যায়ন করে দেখার সময় হয়েছে। স্বাস্থ্যে এর প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই প্লাস্টিক কমিয়ে দিচ্ছে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের জটিল অসুখ-বিসুখ।
কিন্তু তাই বলে আমরা প্লাস্টিক-মুক্ত খাবার খেয়ে যাব বা খেতে পারব, এটা কি একেবারেই সম্ভব আজকের পৃথিবীতে? খুব সম্ভবত, না। আবার সেই সঙ্গে আমাদের নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়েও শরীরে ঢুকবে প্লাস্টিকের বিষ। কোনও মুক্তি নেই আমাদের। এ বিষ আমাদেরই সৃষ্টি। শুরুতেতা হয়তো হয়েছিল না জেনেই, মানুষের জীবনযাত্রায় সুবিধা আনার জন্য বিজ্ঞানের সৃজন। কিন্তু এখন তো আমরা জেনেছি লয়-ক্ষয়-হীন প্রায়-অমর এই প্লাস্টিকের চরিত্র। তবু তার উৎপাদন ও ব্যবহারে কোনও কমতি নেই। জেনেশুনে বিষ বানিয়ে তুলছি আমরা। বাড়িয়েও তুলছি। জেনেশুনেই খেলছি বিষ নিয়ে। সেই প্রবল হলাহল ছড়িয়ে পড়ছে সভ্যতার কোণায় কোণায়। জলে, স্থলে, বাতাসে। সমতলে, পাহাড়ে, সমুদ্রের অতলে। তা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে সভ্যতাকে। এবং সেই সঙ্গে তা ছাড় দিতে নারাজ আমাদের শরীরকেও।
প্রতি বছর গড়ে ৪৮ থেকে ১২৭ কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক মিশে যাচ্ছে মহাসাগরের জলে। সমুদ্রের প্রাণীদের খাবারের সঙ্গে তাদের শরীরে ঢুকছে এই প্লাস্টিক। এমনকী প্লাঙ্কটনের মতো ক্ষুদ্র জীবকেও জড়িয়ে ফেলতে পারে, বা তাদের হজমের পদ্ধতিতেও জড়িয়ে যেতে পারে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক। মাছ, পাইলট তিমি বা ডলফিনের মত সামুদ্রিক প্রাণীর পেটে পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক। সামুদ্রিক পাখি খাবার ভেবে খেয়ে ফেলছে প্লাস্টিকের টুকরো। তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভয়াবহ ক্ষতি হয়ে চলেছে এর ফলে।
সার্বিকভাবে প্লাস্টিক যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে আমাদের বাস্তুতন্ত্রকে। এ আমাদের অবশ্যম্ভাবী ভবিতব্য। আপাতত এর থেকে মুক্তি নেই আমাদের। বড়জোর আমরা সচেতনতা বাড়িয়ে সীমিত করে ফেলতে পারি আমাদের সরাসরি প্লাস্টিক খাবার পরিমাণটা।
আপাতত চা আর তার মধ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা নিয়ে দেশ-বিদেশের চা-রসিকের আড্ডায় আলোচনাটা চালু রাখা জরুরি!
আমাদের আগামী দিনের আন্দোলন হোক প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে!
.