সাম্প্রতিক বিষয়াবলি। তুরষ্কের সিরিয়ায় কুর্দিদের উপর হামলা। প্রেক্ষাপট, কারণ ও প্রতিক্রিয়া।
--------------------
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ রাশিয়ার এক ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাই আরব বসন্তের সময় সিরিয়ায় যখন আসাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় পশ্চিমা মিডিয়া তাতে ঘি ঢালে। জনতার উপর কেমিক্যাল অস্ত্রের প্রয়োগসহ বিভিন্ন অপকর্ম ফাঁস করে দেয়। ইতিমধ্যেই আল কায়েদার কিছু সদস্য মিলে ইরাক ও সিরিয়ায় গড়ে তোলে আইসিস। এই আইসিস সিরিয়া, আমেরিকা, আরব দেশ সবার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সে সময় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মুসলিম আইসিসে যোগদান করে। তারা বিভিন্ন তেলকূপ দখল করে এবং সেই তেল চোরাপথে বিশেষ করে তুরষ্কের কাছে বেচে অনেক ধনী ও ক্ষমতাধর হয়ে যায়।
.
২০১৪ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর আমেরিকা তার আরব মিত্রদেশগুলো নিয়ে আইসিসের উপর বোমা হামলা শুরু করে। পরবর্তী এক বছরে সিরিয়ায় আমেরিকা ২০০০ সৈন্য ডিপ্লয় করে যার বেশিরভাগেই ছিল স্পেশাল ফোর্সের সদস্য। এখানে আমেরিকা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল। আইসিসকে খতম করা ও বাশার আল আসাদকে উচ্ছেদ করা। আমেরিকা অক্টোবর ২০১৫ তে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স (SDF) তৈরি করে। এতে প্রায় ৫০০০০ সদস্য ছিল যাদের প্রায় সবাই ছিল সিরিয়ান কুর্দি।
কুর্দি জনগোষ্ঠী হচ্ছে আরবের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী যাদের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি!! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সাইমন-পিকটস চুক্তির মাধ্যমে যখন ব্রিটেন ও ফ্রান্স অটোমান সাম্রাজ্যকে বিভক্ত করছিল তারা এই কুর্দি জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন দেশে ভাগ করে দেয়। কুর্দিদের জন্য কুর্দিস্তান হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি আর। বর্তমানে এই কুর্দি জনগোষ্ঠী ইরান,ইরাক, সিরিয়া, তুরষ্ক বিভিন্ন দেশে বিভক্ত। তাদের অর্ধেকেই বাস করে তুরষ্কতে। সবচেয়ে কম আছে সিরিয়ায় যা প্রায় ১৭ লাখ। এছাড়া ইরাকে আছে প্রায় ৫৫ লাখ কুর্দি ও ইরানে ৮১ লাখ।
আমেরিকার মূল পরিকল্পনা ছিল সিরিয়া ও ইরাকি কুর্দিদের নিয়ে কারণ তাদের অবস্থা অপেক্ষাকৃত বেশি খারাপ। বেকারত্ব সমস্যাব,খাদ্য সমস্যায় তারা জর্জরিত। আমেরিকা ঠিক করে নিজেদের যুদ্ধ তারা কুর্দিদের দিয়ে করাবে। আমেরিকা কুর্দিদের কনট্র্যাকচুয়াল জব দেয়, তাদের ট্রেনিং দেয়, অস্ত্র দেয়। রাশিয়ান সৈন্যদের দৃঢ়তায় বাশার আল আসাদকে উৎখাত করতে না পারলেই কুর্দিরা আইসিসকে প্রায় শেষ করে দেয়।
এদিকে ২০২০ সালে আমেরিকার নির্বাচন। ট্রাম্প ঠিক করেছে নির্বাচনের আগেই আফগানিস্তান ও সিরিয়ার থেকে সৈন্য নিয়ে আসবে৷ কারণ এসব যুদ্ধ ও সৈন্য মোতায়নে আমেরিকার প্রায় ৭ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। পাকিস্তানকে সাথে নিয়ে ট্রাম্প তালেবানের সাথে একটি বৈঠক করেছিল কিন্তু সেটা সফল হয়নি। এ মুহুর্তে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করলে আবার পুরো আফগানিস্তান তালেবানের দখলে যাবে এবং যুদ্ধে খরচ হওয়া এই ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার পুরাই নষ্ট। তাই ট্রাম্প চেয়েছিল যেভাবেই হোক অন্তত ইলেকশনের আগে সিরিয়া থেকে এই ২০০০ সৈন্য নিয়ে আসা। তবে কুর্দিদের ইউস করে এইভাবে সৈন্য প্রত্যাহার আমেরিকাতেই অনেক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আমেরিকান পলিটিশিয়ানরাই বলছে এতে ভবিষ্যতে কোন দেশ আমেরিকার সাথে কোন ডিল করার আগে ১০ বার ভাববে।
#তুরষ্ক কেন সিরিয়ান কুর্দিদের উপর হামলা করছে?
সিরিয়ান কুর্দিদের হাতে এখন অনেক অত্যাধুনিক অস্ত্র আছে। আমেরিকার ট্রেনিং আছে। তুরষ্ক ভয় পাচ্ছে এরা তুরষ্কের কুর্দিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে প্রভাবিত করতে পারে। তাই তুরষ্ক আগেই তাদেরকে খতম করে দিতে চাচ্ছে। তুরষ্কের রীতিমত গণহত্যার পরিকল্পনা দেখে সারা বিশ্ব শংকিত। তাছাড়া তুরষ্কের অতীত ইতিহাসেও আছে 'আর্মেনীয় জেনোসাইড' নামে ইতিহাসের অন্যতম কলংকিত অধ্যায় । গত শতাব্দীতেই অটোমান সাম্রাজ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়ে আর্মেনিয়ান জেনোসাইডে ১৫ লাখ আর্মেনীয়কে হত্যা করেছিল যেখানে পুরো আর্মেনিয়াতে ছিল মাত্র ৩০ লাখ লোক!!
তুরষ্ক তাদের আরো একটি পরিকল্পনার কথা বলে। গত ৫ বছরে ৩০ লাখ রিফিউজি তুরষ্কে প্রবেশ করেছে। তাই তুরষ্ক চাচ্ছে সিরিয়ার কুর্দি অধ্যুষিত সেই এলাকাটা খালি করে সেখানে তাদের রিফিউজি সেটেল করবে। এরদোগান হুমকি দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো এর বিরোধিতা করলে ইউরোপীয় দেশগুলো রিফিউজি দিয়ে প্লাবিত করে দিবে। তবে এসডিএফ এখন নিরুপায় হয়ে সিরিয়ান সরকারের সাথে একটি চুক্তি করেছে। এটি বাশার আল আসাদের সরকারকে আরো বৈধতা প্রদান করবে।
কুর্দি জনগোষ্ঠী এখন আমেরিকার কাছে আবেদন করছে তাদেরকে সাহায্য করতে। তাদের উপর এথনিক ক্লিনসিং হতে যাচ্ছে। তারা আমেরিকাকে সাহায্য করেছে এখন আমেরকা যেন কুর্দিদের বিপদের সময় তাদের পাশে দাঁড়ায়।
এদিকে মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই হামলার নিন্দা জানিয়ে লিগ অব আরব স্টেটে একটি জরুরী মিটিংয়ের ডাক দিয়েছেন। সৌদি আরব ও এর নিন্দা জানিয়েছে। বলেছে, আইসিস দমনে কুর্দিরা ব্যাপক সাহায্য করেছে। তাদের উপর বোম্বিং প্রচণ্ড অনৈতিক কাজ। ইতিমধ্যেই অনেক বেসামরিক মানুষ তুরষ্কের হামলায় মারা গিয়েছে। আমেরিকা কি শেষ পর্যন্ত কুর্দিদের বাঁচাতে আসবে এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন