যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় যুদ্ধ শুরু করেছিল সিরিয়ায় ২০১৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া ইরাকে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের ওপর বিমান হামলা চালিয়ে এই যুদ্ধ শুরু করেছিল। তবে ইরাক আর লিবিয়ার সঙ্গে পার্থক্য ছিল- সিরিয়ায় বাসার আল আসাদকে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। এখানে অবশ্য রাশিয়ার একটা যোগসূত্র আছে। রাশিয়া বাসার আল আসাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। রাশিয়ার বিমান সিরিয়ায় মোতায়েন করা হয় এবং এই বিমান ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের ওপর বোমাবর্ষণ করে ২০১৭ সালে তাদের সিরিয়া থেকে উৎখাত করে। তাই বাসার আল আসাদকে সাদ্দাম হোসেন কিংবা গাদ্দাফির মতো ভাগ্যবরণ করতে হয়নি। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ এখনো চলছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের অবনতি ও ইরান-সৌদি আরব যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এলো এই ড্রোন হামলা। এই পরিস্থিতি কী যুক্তরাষ্ট্রকে আরেক দফা যুদ্ধে টেনে নিয়ে যাবে?
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ৫ জাতি ইরানের সঙ্গে একটি পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যা Joint Comprehensive Plan of Action (JCPA) নামে পরিচিত। ওই চুক্তি বলে ইরান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা কোনো পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করবে না। ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে ইরান সাময়িকভাবে তার সব পারমাণবিক কর্মসূচি ‘বন্ধ’ করে দিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে সন্তুষ্ট ছিল না। ট্রাম্প নিজে একাধিকবার তার টুইট বার্তায় JCPA সমঝোতার সমালোচনা করেছিলেন এবং ২০১৮ সালের মে মাসে ট্রাম্প JCPA সহযোগিতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। যদিও এ সময়ে JCPA স্বাক্ষরকারী দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন ও জার্মানি থেকে বলা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র একতরফভাবে এই চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারে না। ২০১৮ সালের পর থেকেই ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। ২০১৯ সালে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। ২০১৯ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র আরব সাগরে বিমানবাহী জাহাজ আব্রাহাম লিংকন মোতায়েন করে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, ইরানকে চাপে রাখা। ওই সময় স্ট্রেইট অব হরমুজ প্রণালিতে দুটি তেলবাহী জাহাজে আক্রমণ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র তখন অভিযোগ করেছিল, ইরানি বিপ্লবী বাহিনীর কমান্ডোরা ওই জাহাজে হামলা চালিয়েছে। জুন মাসে ইরান ইরানি সীমানায় যুক্তরাষ্ট্র একটি ড্রোন গুলি করে নামায়। পরে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এক হাজার মেরিন সেনা মোতায়েন করে। এরপর থেকেই দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। এই রেশ ধরেই এলো সৌদি আরবের আরামকো তেল উৎপাদন কেন্দ্রে ড্রোন হামলা।
এই ড্রোন হামলায় সৌদি আরবের তেল উৎপাদন হ্রাস পাবে, এটাই স্বাভাবিক। আর এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের শঙ্কা বাড়িয়ে দেবে। সৌদি তেল সাধারণত এই ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’ প্রণালি ব্যবহার করে ইউরোপ, জাপান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। একটা তথ্য দিই। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে প্রতিদিন ১৪ লাখ ব্যারেল জ¦ালানি তেল পারস্য অঞ্চল থেকে আমদানি করেছে। আর এই আমদানিতে ব্যবহৃত হয়েছে স্ট্রেইট অব হরমুজ প্রণালি। যুক্তরাষ্ট্রের মোট জ¦ালানি তেলের আমদানির ১৮ ভাগ আসে এই পথ থেকে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের একটা উৎকণ্ঠা থাকবেই। যুক্তরাষ্ট্র চায় স্ট্রেইট অব হরমুজ থেকে তেল আমদানিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হোক। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী যেকোনো সময়ে এই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। নিঃসন্দেহে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরান একটি ফ্যাক্টর। ইরান অলিখিতভাবে এ অঞ্চলে বসবাসরত শিয়াদের নিয়ে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তুলেছে। সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন– এমনকি সৌদি আরবেও শিয়ারা রয়েছে। সৌদি আরবের ভয়, এই শিয়াদের নিয়ে। সৌদি রাজবংশ মনে করে, ইরান সৌদি শিয়া ধর্মাবলম্বীদের ব্যবহার করে খোদ সৌদি রাজবংশের পতন ডেকে আনতে পারে। এ জন্য ইরানকে নিয়ে সৌদি আরবের বড় ভয়, ইরান থেকে যেকোনো হামলা মোকাবিলায় সৌদি আরব ইতিমধ্যে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তুলেছে। শুধু তাই নয়, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যকেও মোতায়েন করা হয়েছে। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর পঞ্চম ফ্লিট লেবাননে মোতায়েন রয়েছে। এ ছাড়া কুয়েতে (ক্যাম্প বুয়েরিং, আলি আল সালেম, ক্যাম্প আরিফজান), কাতারে (আল উদেইদ, আস সালিয়া ক্যাম্প), আরব আমিরাতে (আল-দাফরা, জেবেল আলি পোর্ট, ফুজারিয়া ক্যাম্প) যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ও বিমানবাহিনীর ঘাঁটি রয়েছে।
.
ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য ‘যুদ্ধে’ এসব ঘাঁটিতে মোতায়েনকৃত বিমান ব্যবহার করা হবে। আল জাজিরা তাদের এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, কীভাবে ইরানকে ঘিরে রেখেছে মার্কিন ঘাঁটিগুলো। এই যখন পরিস্থিতি, তখন ইরানের পাশে আছে চীন, রাশিয়া ও এই অঞ্চলের শিয়া নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন দেশের সরকার। একটা ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরব-ইসরায়েলি লবি যদি ইরান আক্রমণ চালায় (?), তাহলে এই যুদ্ধ শুধু ইরানের সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা সমগ্র পারস্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। এ অঞ্চলের তেল উত্তোলন ব্যাহত হবে, যার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়বে সমগ্র বিশে^। ইরাক আর সিরিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে ইরানের পরিস্থিতি মেলানো যাবে না। সিরিয়া কিংবা ইরাকে বিভিন্ন উপদল ছিল। গৃহযুদ্ধে এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু ইরানে তেমনটি নেই। মার্কিনিদের বিরুদ্ধে সবাই মূলত এক। ইরান সরকারের প্লাস পয়েন্ট এটাই।
.
এখন কী হতে পারে ইরানে? ইরান সংকটে দুটো ফ্যাক্টর– মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলে নির্বাচন। ইসরায়েলে পার্লামেন্ট নির্বাচন চলতি সেপ্টেম্বর মাসেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে নির্বাচনের পর সরকার গঠন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। কেননা, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি পেয়েছে ৩১ আসন (মোট আসন ১২০)। মাত্র একটি আসন বেশি পেয়ে (৩২) এগিয়ে আছে ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট পার্টি। সরকার গঠনে দরকার ৬১ আসন। এই ক্ষেত্রে সেখানে একটি জাতীয় সরকার গঠিত হতে পারে অথবা পুনর্নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে ইরান আক্রমণ নিয়ে ইসরায়েলি নেতারা এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকবেন। অন্যদিকে, ২০২০ সালে নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। ট্রাম্প এ মুহূর্তে ইরানের ব্যাপারে ‘যুদ্ধে’ যাওয়ার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। এটা তার একদিকে ‘প্লাস পয়েন্ট’, অন্যদিকে ‘মাইনাস পয়েন্ট’ও। তবে ইরানের ব্যাপারে অর্থনৈতিক অবরোধ আরও কড়াকড়ি করার নির্দেশ তিনি দিয়েছেন। ইতিমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে ট্রাম্প সৌদি আরব পাঠিয়েছেন। সেখানে পম্পেও এই ড্রোন আক্রমণের জন্য ইরানকে দায়ী করেছেন এবং এ ঘটনাকে ‘act of war’ অর্থাৎ ‘এক ধরনের যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। পম্পেওর এই বক্তব্য স্পষ্ট– এক ধরনের হুঁশিয়ারি। যুক্তরাষ্ট্র এখন জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনে ইরানের বিরুদ্ধে কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করতে চাইবে। ট্রাম্প যেখানে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার এবং যেখানে তালেবানদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় যেতে চান, সেখানে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবেন কি না সেটা একটা প্রশ্ন। ইরানি প্রেসিডেন্ট চলতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। প্রেসিডেন্ট রুহানি পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আর যোগ দিচ্ছেন না। এটাই প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, সম্পর্কের অবনতি তা কি শেষ পর্যন্ত দেশ দুটোকে একটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে? এর জবাব এ মুহূর্তে দেওয়া কঠিন। যেকোনো যুদ্ধে ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’ বা হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে (যেখান থেকে প্রতিদিন ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল বিভিন্ন গন্তব্যে যায়), যা খোদ ইরানের জন্যও ভালো কোনো খবর নয়। কেননা, ইরান তার ক্রেতাদের (বিশেষ করে চীন) জন্য তেল সরবরাহের একমাত্র পথ হচ্ছে এই হরমুজ প্রণালি। চীন, ইরান ও সৌদি তেলের ওপর নির্ভরশীল। চীনও চাইবে না পারস্য অঞ্চলে যুদ্ধ হোক, যাতে করে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যায়।