##বাজেট এলো যেভাবে
বাজেট একটি ইংরেজি শব্দ যা বাংলাদেশের সরকারি বিভিন্ন নথিপত্রে ব্যবহৃত হয় বাজেট হিসেবেই। মানে বাজেটের যুত্সই কোনো বাংলা চোখে পড়েনি। আর অফিসিয়াল ভাষায় শব্দটি বাজেট নামেই রয়েছে সরকারি ওয়েবসাইটে।
বাজেট শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ বোওগেট থেকে। যার অর্থ চামড়ার ব্যাগ।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় ১৭২০ সালে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে প্রথম জাতীয় বাজেট ও রাজস্বনীতি উত্থাপন করেন স্যার রবার্ট ওয়ালপোল। এর ঠিক ১৩ বছর পর ওয়ালপোল সরকারের করের বোঝা কমাতে তার রাজস্ব পরিকল্পনায় বিভিন্ন ধরনের পণ্যের (ওয়াইন, তামাক) ওপর আবগারি শুল্ক ধার্য করার প্রস্তাব করেন।
এতে সাধারণ জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে যে উইগ পিয়ার উইলিয়াম ‘দ্য বাজেট ওপেন অর অ্যান আনসার টু এ প্যামফলেট’ নামে একটি পুস্তিকা লিখে ফেলেন। সেবারই প্রথম সরকারের রাজস্বনীতিতে বাজেট শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু, বাজেটের আনুষ্ঠানিক রূপ পায় ১৭৬০ সালে।
##ভারতীয় উপমহাদেশে বাজেট
১৮৫৭ সালে সারা ভারতবর্ষে সিপাহী বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে আর তখনই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ব্যবস্থা রদ হয়। ভারতের ভাগ্যের চাবিকাঠি চলে যায় ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয় ‘ভারত শাসন আইন’।
রানির হয়ে ভারতের শাসনভার দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ভাইসরয়কে। ভাইসরয়কে পরামর্শ দেওয়ার জন্য তৈরি হয় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল। তারই অর্থসংক্রান্ত বিষয় দেখাশোনা করতেন জেমস উইলসন।
১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল জেমস উইলসন কলকাতায় ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম বাজেট বক্তৃতা দেন এবং ১৮৬০-৬১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন।
এই উপমহাদেশে উইলসনই প্রথম গণতান্ত্রিক ওয়েস্ট মিনস্টার টাইপের সরকার পদ্ধতির আওতায় সরকারের আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনার বাজেট পেশ করেন, যা আজও বিদ্যমান বাংলাদেশ এবং ভারতে। সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত ফসলি সনের আদলে তখন এপ্রিল-মার্চকে অর্থবছর নির্ধারণ করা হয়।
তিনিই প্রথম বাজেটে আধুনিক আয়কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এর আগে এ দেশে বিভিন্ন প্রকার কর বা খাজনা প্রকৃতির রাজস্ব আয়ের ব্যবস্থা ছিলো।
উইলসনের আরেকটি বিখ্যাত পরিচয়- তিনি ছিলেন লন্ডনের প্রভাবশালী ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৫৩-এ প্রতিষ্ঠা করেন চার্টার্ড ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। এই ব্যাংক ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও চীনে শাখা খোলে। পরবর্তীতে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে তৈরি হয় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।
১৮৫৯-এর নভেম্বরে ভারতে এসে ১৮৬০-এর এপ্রিলে বাজেট পেশের পরপরই ডায়রিয়াতে ভুগে তিনি মারা যান কলকাতাতেই।
##পাকিস্তান আমলে বাজেট
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশের প্রথম বাজেট মুসলিম লীগ সরকার উপস্থাপন করে। সে সময় অর্থবছর এপ্রিল থেকে শুরু হতো। যদিও পরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার জুলাই-জুন অর্থবছর ঘোষণা করে।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ পূর্ববাংলা প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসে জগন্নাথ হলের হলঘরে, যেটি ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর ধসে পড়ে যায়।
১৯৪৮-৪৯ সালের প্রথম বাজেট পেশ করেন হামিদুল হক চৌধুরী। ওই অর্থবছরে ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বাজেট ঘাটতি ছিলো।
ব্যয় বিবেচনায় ওই বাজেটের আকার ছিলো সাড়ে ৪১ কোটি টাকা। পরিসংখ্যান বলছে, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিলো ১১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ঋণ খাতে আদায় ২৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তবে রাজস্ব খাতে ব্যয় ধরা হয় ১২ কোটি সাড়ে ৮ লাখ টাকা। আর পরিশোধে ব্যয় ১৯ কোটি ৭ লাখ টাকা।
##স্বাধীন বাংলাদেশে বাজেট
এবার আসি স্বাধীন বাংলাদেশে। স্বাধীন দেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছিলেন।
আর এবছর নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল দেশের ৪৮তম বাজেট উপস্থাপন করবেন।
তাজউদ্দীন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন; সেই বাজেটের আকার ছিলো ৭৮৬ কোটি টাকা। বর্তমান অর্থমন্ত্রীর নতুন অর্থবছরের বাজেট .... কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশের বাজেট উপস্থাপনে একটি স্থানে এখনও অনন্য তাজউদ্দীন আহমদ। কারণ তিনি ছিলেন দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ রাজনীতিবিদ যিনি সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেছেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী মোট ১২জন অর্থমন্ত্রী বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেছেন আর ১৩তম ব্যক্তি হিসেবে লোটাস কামাল আগামীকাল বাজেট পেশ করবেন। তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া বাকিরা ছিলেন হয় অবসরপ্রাপ্ত আমলা, অথবা অর্থনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী। কেউই ফুলটাইম রাজনীতিবিদ নন।
অর্থমন্ত্রীরা বাজেট বক্তৃতায় বিভিন্ন ধরনের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন। তবে একই উদ্ধৃতি দুজন অর্থমন্ত্রীর ব্যবহার বিরল। তেমনটিই ঘটেছে বাংলাদেশে। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরের বাজেটে এম সাইফুর রহমান বক্তব্য শেষ করেছিলেন এভাবে- ‘পৃথিবীর একটি সুপ্রাচীন দেশের একটি উক্তির কথা মনে পড়ে: “হাজার মাইলের যাত্রা শুরু হয় একটি পদক্ষেপ দিয়েই।” আসুন আমরা সমবেত হয়ে সেই একটি পদক্ষেপ নেই।’
১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যের শেষে অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া বলেছিলেন, ‘চীনা ভাষায় একটি প্রবাদে যথার্থই বলা হয়েছে, “হাজার মাইলের ভ্রমণ শুরু হয় একটি ক্ষুদ্র পদক্ষেপের মাধ্যমেই।” আমাদের গন্তব্য যতো দুর্গমই হোক না কেনো আমরা চলতে শুরু করেছি।’
##বাজেট উপস্থাপনের খতিয়ান
এক অর্থবছরে দুবার বাজেট উপস্থাপনের উদাহরণও আছে আমাদের। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন। এর পরে নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্ব নিয়ে মূল আর্থিক কাঠামো ঠিক রেখে নতুন করে বাজেট উপস্থাপন করেন শাহ এ এম এস কিবরিয়া।
আর সংসদে সমান ১২ বার বাজেট পেশ করে রেকর্ড করেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এবং আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে টানা দশবার বাজেট দিয়ে মুহিত রেকর্ড গড়েছেন। মুহিত শেখ হাসিনার সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে টানা ১০টিসহ মোট ১২টি বাজেট পেশ করেছেন। এর আগে তিনি এরশাদ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-১৪ এই দুই অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছিলেন।
বাজেট যে শুধু অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা দিয়েছেন তা কিন্তু নয়। বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সামরিক শাসক হিসেবে তিনটি বাজেট উপস্থাপন করেন।
তাজউদ্দীন আহমদ তিনটি, এএমএস কিবরিয়া ছয়টি, এম সাইদুজ্জামান চারটি বাজেট দেন। অর্থ-উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম দুটি এবং ড. ওয়াহিদুদ্দিন মাহমুদ একটি বাজেট পেশ করেন।
এরশাদ সরকারের দুই অর্থমন্ত্রী এমএ মুনিম দুটি এবং ড. ওয়াহিদুল হক একটি বাজেট উপস্থাপন করেন।
বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ড. মীর্জা নুরুল হুদা একটি বাজেট দেন। খন্দকার মোশতাক সরকারের আমলে দেশের প্রথম টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেট দেন ডক্টর এ আর মল্লিক।
চার মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের চারজন অর্থমন্ত্রী ১৯টি বাজেট দিয়েছেন।
বিএনপির তিন মেয়াদের শাসন আমলে তিনজন ১৬টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন। জাতীয় পার্টির আমলে নয়টি বাজেট চারজন অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেন। তিনটি বাজেট দিয়েছে দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার।