***ইরান সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে কী করবে ইউরোপ***
কঠিন এক পরীক্ষার মুখে পড়েছে ইউরোপ। চাপের মুখে বারবার তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মাথা নোয়াবে, নাকি এবার সোজা মুখের ওপর বলবে, ঢের হয়েছে আর তোমাদের হয়ে যুদ্ধ নয়। যুক্তরাষ্ট্র আবারও পারস্য উপসাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। মনগড়া অভিযোগে, চাপ প্রয়োগ বা যুদ্ধের পাঁয়তারা করে বাগে আনতে চাইছে ইরানকে।
কিন্তু হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের এই চাপ প্রয়োগ বা হম্বিতম্বির কারণ কী! ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, তারা ২০১৫ সালে করা পারমাণবিক কর্মসূচি বা জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন বা (জেসিপিওএ) মানছে না। আর এই চুক্তি না মেনে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে ও তাদের উৎপাদিত ইউরেনিয়াম সঞ্চয় করছে।
২০১৫ সালে ইরান পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন দেশগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিটি ছয়টি দেশ—চীন, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন দীর্ঘ আলোচনার পর সম্পন্ন করেছিল।
চুক্তির পরপরই ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশ ইরানের ওপর অর্পিত নানা অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়। ১৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তির শর্ত ছিল, ইরান তার উৎপাদিত ইউরেনিয়ামের ৯৮ শতাংশ দেশে সঞ্চয় না করে বাইরে বিক্রি করতে বাধ্য থাকবে। তবে চুক্তির আগেও ইরান বলেছিল তাদের পারমাণবিক পরিকল্পনা শান্তিপূর্ণ।
২০১৮ সালের ৪ মে ইরানের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক কর্মসূচি বা জেসিপিওএ থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আবারও ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে এবং অন্যদেরও এই অবরোধে শামিল হওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া চুক্তিবদ্ধ সবাই এই পারমাণবিক চুক্তিটি রাখার পক্ষে রয়েছে।
পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা ও নতুন করে অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা দেওয়ার পর জার্মানির চ্যান্সেলর অাঙ্গেলা ম্যার্কেল, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। বিবৃতিতে তাঁরা ইরানকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছিলেন।
ইইউর পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তাবিষয়ক প্রধান ফেদেরিকা মঘেরিনিও তখন জানিয়েছিলেন, পারমাণবিক যুদ্ধের উত্তেজনা হ্রাস করতে এই চুক্তি করা হয়েছে। তাই এ চুক্তি ভাঙার প্রশ্নই আসে না। ইরান চুক্তির শর্ত মেনে চললে ইইউর সহযোগিতা আরও বাড়বে বলে তিনি জানিয়েছিলেন।
২০০৩ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরাকের কাছে রাসায়নিক অস্ত্র আছে—এই মিথ্যা অভিযোগ তুলে দেশটিতে অনৈতিক ও অযাচিতভাবে বর্বরোচিত হামলা করেছিল। এবারও অনেকটা তা–ই, কোনো তথ্যপ্রমাণ ও তদন্ত প্রতিবেদন ছাড়াই ইরানকে পারমাণবিক কর্মসূচি চুক্তি ভাঙার দায়ে দোষারোপ করা হচ্ছে।
২০০৩ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিনরা ইউরোপের সব দেশের সহযোগিতা পায়নি। তবে পাশে পেয়েছিল যুক্তরাজ্য, হল্যান্ড ও পোল্যান্ড—এই তিন দেশকে।
আর এবার এই প্রথম ইউরোপীয় ইউনিয়ন এককাট্টা হয়ে বলছে, ২০১৫ সালে করা পারমাণবিক চুক্তি আমাদের নিরাপত্তার জন্যই। তাই যুদ্ধ আমাদের কাম্য নয়। তবে ইইউ সদস্যদেশগুলো কতটা শক্তি সঞ্চয় করে ইরানের প্রতি মার্কিন আস্ফালনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় আছে।
ইরানে বড় অর্থনৈতিক বাজার রয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের আরও অন্য দেশগুলোর। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে, আর সেই অবরোধে যেন ইউরোপীয় বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য করছে, তারাও যেন তাতে শামিল হয়, তার জন্য চাপ দিচ্ছে।
ইউরোপের নানা দেশের মার্কিন রাষ্ট্রদূতেরা নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে এ ব্যাপারে চিঠি দিয়েছে। প্রচ্ছন্ন হুমকির সুরে চিঠিতে লেখা হয়েছে, ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক না ছাড়লে তাদের প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবে না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের ওপর অনৈতিক অবরোধ আরোপ করা মার্কিনদের পুরোনো স্বভাব।
কিউবার বিরুদ্ধে ৬০ বছর অবরোধ করেও ফিদেল কাস্ত্রোর ক্ষমতা খর্ব করা যায়নি। গত পাঁচ বছর ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ করেও রাশিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা পুতিনের ক্ষমতা হ্রাস পায়নি। ইরানের প্রতিও দীর্ঘদিনের অবরোধে সে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েনি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যত আস্ফালনই করুক, সর্বত্রই তঁার বৈদেশিক নীতি ব্যর্থ হচ্ছে। উত্তর কোরিয়া, চীন, রাশিয়া, ইইউ এবং এই মুহূর্তে ভেনেজুয়েলা, ইরান—সবখানেই তঁার পেশিশক্তির বিজয় সম্ভব হয়নি। ইউরোপের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও সম্প্রতি ব্রাসেলস সফর করেছেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের দুষ্কর্ম ও অযৌক্তিক চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত ইউরোপ মাথা নোয়াবে, নাকি তার পুরোনো মিত্রের মুখের ওপর বলবে, আর যুদ্ধ নয়—তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।