## কপ-২৫ সম্মেলন
♦গত ১৫ ডিসেম্বর স্পেনের মাদ্রিদে শেষ হলো পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশ্বের সবচেয়ে বড় সম্মেলন কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস বা কপ-২৫। ১৩ ডিসেম্বর শুক্রবার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কোনো সমঝোতা না হওয়ায় প্রথমে শনিবার পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। কিন্তু শনিবারও সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব না হওয়ায় ১৫ তারিখ রবিবার পর্যন্ত বৈঠক প্রলম্বিত হয়।
♦প্রতিবছরই কপ আসে অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্ন নিয়ে। দুই সপ্তাহের দীর্ঘ আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, বাগিবতণ্ডার পর দেখা যায়, অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় আমাদের, পরবর্তী কপ সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে। কপ-২৫ খুব একটা ব্যতিক্রম নয়। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানোর জন্য আরো বড় লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আগামী বছর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার সম্মতির মধ্য দিয়ে সমাপ্তি টানা হলো কপ-২৫ এর।
♦ জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় বিজ্ঞানীরা যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন এবং দেশগুলো যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তার মধ্যকার ব্যবধান তুলে ধরা হবে আগামী বছরের কপ-২৬ এ। অর্থাৎ এ বছরের সম্মেলনের প্রাপ্তির জায়গাটা অপ্রাপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল।
♦তীব্র জলবায়ু সংকটের মধ্যেই স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে ২ থেকে ১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হলো কপ-২৫। এবারের সম্মেলনে মূল আলোচনা ছিল ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে উল্লিখিত কার্বন নিঃসরণের মাত্রা হ্রাস করার কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
♦অনেক উন্নয়নশীল দেশ এবং জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো আশা করেছিল যে অধিক কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর কাছ থেকে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণের নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আগামী বছরের জন্য তুলে রাখার মধ্য দিয়ে শেষ হলো কপ-২৫ এর।
♦সম্মেলন শেষে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো বিশ্বকে আশার আলো দেখাতে পারেনি। সম্মেলনের শুরুতে দেওয়া আশাবাদী বক্তব্যের বিপরীতে সম্মেলন শেষে দেওয়া জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্যে হতাশার সুরই অনুরণিত হয়েছে।
জাতিসংঘের আয়োজনে প্রতিবছরই জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সব বছরের কপ সমান গুরুত্ব পায় না। সেদিক থেকে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত এবারের কপ-২৫ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল, বিশ্বের সব সদস্য দেশকে ২০২০ সালের মধ্যে ‘ন্যাশনাল ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ যেসব দেশ এখনো কাজটি শেষ করতে পারেনি, তাদের তাগিদ দেওয়ার জন্য এ সম্মেলনটি ছিল শেষ সুযোগ।
♦প্যারিস চুক্তিতে দেশগুলো প্রাক-শিল্প যুগ অর্থাৎ ১৮৫০-১৯০০ সালের চেয়ে তাপমাত্রা দুই ডিগ্রির নিচে রাখতে সম্মত হয়েছিল এবং সম্ভব হলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখার চেষ্টা করা হবে বলেও সবার সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল।
♦কথা ছিল, এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ ৪৫ শতাংশ কমানো হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা হবে। কিন্তু বেশির ভাগ দেশকেই সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বের শিল্পোন্নত ও ধনী দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য যথেষ্ট কাজ করছে না বলে সুইডেনের কিশোরী পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ ‘ফ্রাইডেস ফর ফিউচার’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তাঁর এই আন্দোলন একসময় বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
♦গ্রেটা থুনবার্গ গত ১১ নভেম্বর মাদ্রিদের কপ-২৫ সম্মলনে অভিযোগ করেছেন, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ যাতে কমাতে না হয়, সে জন্য ধনী দেশগুলো বিভিন্ন বিকল্প প্রস্তাব উদ্ভাবন করছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ওই দেশগুলোর নেওয়া পদক্ষেপ যথার্থ নয়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাস্তব পদক্ষেপ এড়াতে ‘চাতুর্যপূর্ণ সৃজনশীল গণসংযোগ’ বন্ধ করতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ।
♦জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক কর্মসূচির তথ্যে দেখা যাচ্ছে, কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ১.৫ এর মধ্যে রাখতে রাষ্ট্রগুলো যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং প্রকৃতপক্ষে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি তার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে জলবায়ু দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং সারা পৃথিবীতে দাবানল, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা ও সংখ্যা বাড়ছে। সে কারণে বাংলাদেশসহ যেসব দেশ জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবের মুখে পড়েছে এবং পড়তে যাচ্ছে, সেসব দেশ এ ধরনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় কপ-২৫ সম্মেলনে ক্ষতিপূরণের দাবিকে জোরালো করেছে।
♦শিল্পোন্নত দেশগুলো যা-ই বলুক, এটা আজ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় যে দুর্যোগটি সামনে চলে এসেছে তা হলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ বাড়ছে।
♦জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা জার্মান ওয়াচ কর্তৃক প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকিসূচক ২০২০’ অনুযায়ী, জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার কিছু অংশ পানির নিচে চলে যেতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে আমাদের অনেক মিঠা পানির নদীতে লবণাক্ততা বেড়ে যাবে।
♦জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি কর্তৃক ২০১৮ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত ‘এমিশন গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৮’ বলছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি বন্ধের জন্য নেওয়া বৈশ্বিক চেষ্টা তেমন কোনো কাজে আসছে না। চার বছর পর্যন্ত স্থিতাবস্থায় থাকার পর কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত শিল্প ও জ্বালানি খাতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ স্থিতাবস্থায় ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
♦ ২০১৮ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি ও শিল্পকারখানা থেকে কার্বন নিঃসরণ রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। কিন্তু বর্তমানে বেশি পরিমাণে কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর যে স্তিমিত উদ্যোগ বা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারার সম্ভাবনা বেশ কম।
♦যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য এক বছর সময় প্রয়োজন। তবে প্যারিস চুক্তির সঙ্গে না থাকলেও জলবায়ু কনভেনশনের সঙ্গে যুক্ত থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মনোভাব ও সিদ্ধান্ত যা-ই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের একটি বড় অংশই মনে করে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে আমাদের যথেষ্ট কাজ করা দরকার।
♦গত ১১ ডিসেম্বর কপ-২৫ সম্মেলনে দেওয়া জাতিসংঘ মহাসচিবের একটি গুরুত্ববহ বক্তব্যের দিকে নজর দেওয়া যায়। তিনি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অচিরেই মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে। কার্বন নিঃসরণকারী বড় দেশগুলোকে বুঝতে হবে যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা ব্যর্থ হলে, সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হবে।
♦জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে এবং বিশ্ব উষ্ণতর ও আগের চেয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে উল্লেখ করে জাতিসংঘ মহাসচিব এ সম্মেলনে আরো বলেছেন, ২০১৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে স্বাক্ষরিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধির প্রবণতায় লাগাম টানতে হবে।
♦জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ যে বাড়ছে বিজ্ঞানীরা তা নিশ্চিত করেছেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা দেখেছি সিডর, আইলা, নার্গিস, মহাসেন, মোরা, ফণী ও বুলবুল। তাই বাংলাদেশকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যে টিকে থাকার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। সারা দেশ ঘূর্ণিঝড়ের হুমকির মুখে থাকলেও উপকূলীয় অঞ্চলের ঝুঁকি অনেক বেশি।
♦এসব এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ ও তীব্রতা বাড়বে। তা মোকাবেলায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় উপকূলীয় জনগণের আশ্রয় নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমানোর লক্ষ্যে কৃত্রিম বন বা সবুজ বেষ্টনী সৃষ্টি করতে হবে।
♦এ কথা আজ স্পষ্ট যে, জলবায়ু পরিবর্তনের যে বিপদাশঙ্কা, বাংলাদেশকে তার মধ্যেই বসবাস করতে হবে। সে জন্য আমাদের হাতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টিকে থাকার কৌশল আয়ত্ত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে, তা মোকাবেলায় কার্যকর কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
✅