##মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা
✅পাকিস্তানি শাসকদের কাছ থেকে তথা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করার জন্য, জাতির অধিকার আদায়ের জন্য, সর্বোপরি একটি পতাকার জন্য এদেশের নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা সম্মিলিতভাবে লড়েছিল ১৯৭১ সালে এবং দেশকে মুক্ত করেছিল আর ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা।
♦মুক্তিযুদ্ধে কোনো দল বা গ্রুপের একক অবদান আছে এটা বলা যাবে না।
কারণ কেবল প্রত্যক্ষ যুদ্ধই নয়, পাকিস্তানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করা ও সব শ্রেণীকে উদ্বুদ্ধ করা, বোমা তৈরিসহ গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ, সংবাদ আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক প্রণোদনা, অর্থ-ওষুধ-খাদ্য-বস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা ও সেবাকার্য, খাদ্য ও আশ্রয়দান ইত্যাদি সব কাজই মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য অর্জনে ভূমিকা রেখেছে।
♦উল্লিখিত কর্মকাণ্ডের যে কোনো একটি বাধাগ্রস্ত হলে যুদ্ধে জয়লাভ করা কঠিন হয়ে পড়ত, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে এ কথা ঠিক, এসব কাজে যারা সরাসরি অস্ত্র ধরেছিলেন তাদের প্রাণ হারানোর আশঙ্কা ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এটিও অস্বীকার করা যাবে না যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে কোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাওয়াই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।
♦আর সেক্ষেত্রে নারীর শারীরিক নির্যাতনের ব্যাপারটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব ঝুঁকি সঙ্গে নিয়েও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য পুরুষদের পাশাপাশি অসংখ্য নারী সশস্ত্র যুদ্ধসহ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্নভাবে অংশ নিয়ে প্রমাণ করেছিল তাদের অবদানও সমান গৌরবের।
♦পাকিস্তানিদের হাতে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন, আর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দুই লাখ নারী। সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার কিশোরী, তরুণী, প্রৌঢ়া, এমনকি প্রবীণ নারীরাও কীভাবে তাদের ক্ষতবিক্ষত জীবন পার করেছেন তা কল্পনার অতীত।
♦বর্বতার শিকার এই নারীদের অনেকে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, আবার কেউ কেউ এসএসসি পাস থেকে শুরু করে এমএ পাস, এমনকি এমবিবিএস ডাক্তারও ছিলেন- যারা বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য নেই।
♦মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এসব নারীর মধ্যে স্বল্পসংখ্যক ছিলেন শ্রমজীবী নার্স, সমাজসেবী, গৃহকর্মী ও চাকরিজীবী। অধিকাংশই ছিলেন গৃহিণী। এসব নারীর কেউ কেউ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের ভেতরে।
♦যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভারতে স্থাপিত হাসপাতালে নার্স হিসেবে, চিকিৎসক হিসেবেও কাজ করেছেন কয়েকজন। দেশের বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পৌঁছে দেয়ার ঝুঁকিপূর্ণ কাজও করেছেন অনেকে। এ নারীরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।
♦মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকে পরিমাপ করা যাবে না। এ বিশালতায় যেসব নারী বিভিন্ন অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যমণ্ডিত করেছেন তাদের অনেকের নাম এখনও অজানা।
♦তবে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রীরা সারা দেশেই তৎপর ছিলেন। তারা বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষকে বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত হওয়ার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেছেন।
♦মমতাজ বেগম, কাজী রোকেয়া সুলতানা, বেবী মওদুদ, রানী খান, রোকেয়া কবীর, মনিরা আক্তার প্রমুখ নারী জনমত গঠনের পাশাপাশি ফিজিক্যাল ফিটনেস, মার্চপাস্ট, অস্ত্র চালনা, ফাস্টএইড প্রদান এবং আত্মরক্ষার নানা কৌশল- এসব ব্যাপারে ট্রেনিং নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষা দিতেন।
♦বদরুন্নেসা আহমেদ পুনর্বাসন কার্যকলাপ ও মহিলা সংগঠন মুজিবনগরের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন একাত্তরে। বেগম নূরজাহান খুরশীদ বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকাণ্ড পরিদর্শন ও রিপোর্ট আদান-প্রদানের কাজ করলেও পরবর্তী সময়ে কূটনীতিকের দায়িত্বও পালন করেছেন।
♦সাজেদা চৌধুরী তার বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেন। সেই সঙ্গে সচেতন করতেন কোন কোন বিষয়ে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ মুক্তিযুদ্ধে মহিলা মুক্তিফৌজের হাল ধরেছিলেন।
♦এ মহিলা কমিটি মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছিল। এ কমিটির প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ ছাড়াও গীতারানী নাথ, নিবেদিতা দাস, সুধারানী কর মঞ্জুদেবী, সুষমা দাস ও রমা রানী দাসের নাম উল্লেখযোগ্য।
♦কাজের সুবিধার্থে প্রশিক্ষণ সেবা, ধাত্রীবিদ্যা, প্রাথমিক চিকিৎসা, কুটিরশিল্প, মুদ্রণ ও রামকৃষ্ণ মিশন এরকম কয়েকটি সাব ইউনিটে বিভক্ত হয়ে কাজ করেছেন নারীরা। তাদের মধ্যে প্রশিক্ষণ সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত কানন দেবী, উপাসনা রায়, সুধারানী কর, পূর্ণিমা রানী দাস ও নিপা রানী মুজমদারের নাম উল্লেখযোগ্য।
♦প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ, শুক্লা রানী দে, হেমলতা দেব ছাড়াও আরও অনেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন।
♦নাজিয়া ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। সেলিনা বানু সশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা এবং শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে তৎপর ছিলেন।
এসব কাজে বেগম মুশতারী শফী, মতিয়া চৌধুরী, মালেকা বেগম, আয়েশা খানম, রীনা খান প্রমুখের নামও উল্লেখযোগ্য।
♦মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা এবং সক্ষম নর-নারীদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করে তোলার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
♦শাহনাজ বেগমের কণ্ঠে ‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা’, কল্যাণী ঘোষের ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’- এ রকম অজস্র গানের সুর শুনে মানুষ শিহরিত হয়েছে আর ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশরক্ষার সংগ্রামে।
♦প্রাণ বিষণ্ণ হতে পারে এ কথা জেনেও যেসব স্ত্রী, মাতা, ভগিনী-কন্যারা প্রাণপ্রিয় স্বামী, পুত্র, ভাই ও বাবাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, তাদের এ মহানুভবতার উৎসও অবশ্যই দেশপ্রেম।
♦এক্ষেত্রে শেখ ফজিলাতুন্নেছার নাম সর্বাগ্রে। এছাড়াও জাহানারা ইমাম ও বেগম সুফিয়া কামালসহ হাজারও নাম না জানা নারী যোদ্ধা ছিলেন।
♦মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে সর্বমোট ৬৭৬ বীর যোদ্ধাকে বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন নারীও রয়েছেন। একজন হলেন ডা. সেতারা বেগম ও অন্যজন তারা ভানু বিবি (তারামন বিবি), যাদের ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব দেয়া হয়।
♦বাঙালির এযাবৎকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও গৌরবজনক জাতীয় আন্দোলন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীরাও যে পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধ প্রক্রিয়ার সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অনস্বীকার্য।
✍