বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তি চীনের ভুমিকাঃ
-------------------------------------------------------------------------------------
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি চীনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় ১১ই জুলাই ইয়াহিয়ার প্রতি চৌ এন লাইয়ের চিঠির মাধ্যমে। পিপলস ডেইলিতে সোভিয়েত প্রক্রিয়ার সমালোচনা করা হয় বাংলাদেশকে সমর্থন দানের জন্য। চৌ এন লাই পাকিস্তানের ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ ও “রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায়” চীনের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথা জানান। জেনারেল ইয়াহিয়া খান শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন, চায়নার রেডগার্ডরা পূর্ব পাকিস্তানে এসে তার সৈন্যদের পাশে দাঁড়াবে। এরপর পূর্বপাকিস্তান থেকে বাঙালিদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মিশনটি তার পরিপূর্ণতা লাভ করবে।। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চীন বাঙালির সংগ্রাম ও নির্যাতনের প্রতিও কোন সহানুভুতি দেখায় নি। বরং পাক সামরিক চক্রের প্রতি জানিয়েছিল অকুন্ঠ সমর্থন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসে চীনের নীতি ও কার্যক্রমকে দু'ভাগে ভাগ করা যায় যথা
ক.মুক্তিযুদ্ধের শুরু হতে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত:
----------------------------------------------------------------------------------
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরুর পূর্ব পর্যন্ত চীন
পাকিস্তানপন্থী থাকলেও মোটামুটিভাবে বাঙালির সংগ্রাম বিরোধী কোন মন্তব্য করেনি। তবে গোপনে সে পাকিস্তানের সামরিক চক্রকে নৈতিক শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিল এবং সরাসরি সামরিক উপকরণ সরবরাহ করেছিল। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত-সোভিয়েত চুক্তি সম্পাদনের পর চীনের পাকিস্তানপন্থী নীতি আরও প্রকট হয়ে ওঠে। সেপ্টেম্বর মাসে চীন পাকিস্তানকে এই বলে আশ্বস্ত করে যে, জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় চীন পাকিস্তানকে সাহায্য করবে। । ৫ নভেম্বর চীনাদের আস্থাভাজন ভুট্টোর নেতৃত্বে একটি পাক প্রতিনিধিদল চীন সফরে যায়। চীনের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেঙ ফী পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধান খুঁজে বের করার জন্য আহবান জানিয়েছিলেন। বাঙালি বিরোধী বক্তব্য না রাখলেও পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে চীন নিয়মিতভাবে পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র পাঠাতো। এছাড়াও গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষন দানের জন্য চীন অক্টোবর মাসে ঢাকায় ২০০ (দু'শ জন) সামরিক বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছিল। উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর হতে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান মোট ২০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের চীনা সামরিক উপরকণ সাহায্য হিসাবে পেয়েছে- যার মধ্যে ১৯৭১ সালেই সরবরাহ করেছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র। আর চীনের রাইফেল ও অন্যান্য উন্নত সমরাস্ত্র দিয়েই পাকবাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছে বাঙালিকে।
খ. ৩ ডিসেম্বর হতে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১:
---------------------------------------------------------------------------------------
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের পূর্বাঞ্চলে সামরিক হামলা করলে শুরু হয় সরাসরি পাক-ভারত যুদ্ধ। এ সময় হতে চীন জাতিসংঘে সরাসরি বাঙালি বিরোধী ভুমিকা পালন করতে শুরু করে। পাক-ভারত যুদ্ধের জন্য চীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে দায়ী করে। যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা এবং পাকবাহিনীর বর্বরতার ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করার লক্ষে ৫ ও ৭ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে দু'টি প্রস্তাব উপস্থাপন করে। কিন্তু প্রস্তাব দুটোর বিরুদ্ধে চীন প্রথম ভেটো প্রয়োগ করে এবং চীনের নিজ প্রস্তাবে ভারতকে আগ্রাসী পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, চীন জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের মাত্র ৪০ দিনের মাথায় নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসন লাভের পর প্রথম প্রস্তাবেই ভেটো প্রয়োগ করেছিল। যাহোক, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে চীন এক বিবৃতিতে ‘তথাকথিত' বাংলাদেশের সৃষ্টির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের তীব্র সমালোচনা করে। স্বাধীন বাংলাদেশকে ‘তথাকথিত বাংলাদেশ' বলে অভিহিত করা বাঙালির স্বাধীন অস্তিত্বের প্রতি ছিল চরম ঘৃণা ও অবহেলার শামিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়নি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের বিরোধিতার কারণ:
--------------------------------------------------------------------------------
চীনের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী নীতি গ্রহণের
কারণগুলোকে নিম্নোক্তভাবে চিহ্নিত করা যায়-
১. চীন নিজেই একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র। চীনা, মঙ্গোল, তিব্বতি, তুর্কি ইত্যাদি জনগোষ্ঠী নিয়ে গড়ে উঠেছে চীনের রাষ্ট্রীয় সত্তা। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রশ্নে চীনা জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে তখনই অনেক সমস্যা বিদ্যমান। তাই একাধিক জাতি অধ্যুষিত পার্শ্ববতী কোন দেশে সংগ্রামরত কোন জনগোষ্ঠীকে সমর্থন করলে ভবিষ্যতে তা তার অভ্যন্তরীণ সংহতির প্রতি হুমকি হবার সম্ভাবনা ছিল।
২. চীন নিজেই তাইওয়ানকে মূল ভ‚-খন্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করতে সচেষ্ট ছিল। তাই পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান হতে স্বাধীন হওয়ার সংগ্রামে সমর্থন দিলে তা হতো চীনের দ্বিমুখী নীতিরই পরিচায়ক।
৩. চীন অনুধাবন করেছিল যে, বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলে তা হবে ভারতের প্রভাবাধীন একটি রাষ্ট্র এবং চূড়ান্ত বিচারে চীনের দক্ষিন সীমান্ত এলাকায় এ রাষ্ট্রটি রুশ-ভারত আঁতাতের একটি রাষ্ট্রে পরিণত হবে- যা হবে চীনের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি
হুমকি স্বরুপ।
৪. সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়া সত্তে¡ও চীন-সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্ক ছিল শত্রুতার। তাই দক্ষিন এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নর প্রভাব সম্প্রসারণ মোকাবেলায় পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সহযোগিতা করার প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পর চীন শঙ্কিত হয়ে পড়ে যে, পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকিস্তান দূর্বল হয়ে পড়লে ভারতের মাধ্যমে দক্ষিন এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।
৫. পাকিস্তান ছিল চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাই সংকটকালে চীন যদি পাকিস্তানকে সমর্থন না করে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে, তবে অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যে চীনের বন্ধুত্ব নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হবে।
সুতরাং নিজ সুবিধা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির সব কিছু বিবেচনা করেই চীন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে চীনের যে ভ‚মিকা ছিল তা আপাতদৃষ্টিতে পাকিস্তান ঘেষা হলেও মূলত তা ছিল চীনের জাতীয় নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অখন্ডতা নিশ্চিত করার নীতি। দক্ষিন এশিয়ায় চীনের বিরুদ্ধে রুশ-ভারত আঁতাতের ফলে চীন বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। সুতরাং স্বভাবিক কারণেই সে প্রতিবেশী অপর
রাষ্ট্র পাকিস্তান এবং অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। তবে সরকারিভাবে চীনা নীতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে হলেও চীনের অধিকাংশ জনগণের সমর্থন ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি। তাই ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর ভুট্টোর চীন সফরকালে পিকিং-এ একদল চীনা যুবক ভুট্টো ও পাকিস্তান বিরোধী স্লোগান দিয়ে জানতে চায় যে, পাকিস্তান সরকার কেন পূর্ব পাকিস্তানিদের ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, চীন জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী হয়ে প্রথমবারই ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও চীন বাংলাদেশকে ‘তথাকথিত' বাংলাদেশ বলে আখ্যায়িত করে।
বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরদিন ১৬ ই আগস্ট ১৯৭৫ চীন ও সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
-------------------------------------------------------------------------
//কোন সাজেশান থাকলে কমেন্টে জানাবেন//
বই তথ্যসুত্রঃ
১। ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাশক্তির ভ‚মিকা।
২। মেজর রফিকুল ইসলাম পি.এস.সি, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট : বিরোধী শক্তি ও বৃহৎশক্তির প্রতিক্রিয়া।
৩। এ.এস.এম. সামছুল আরেফিন সম্পাদিত, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান।
৪। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, বাংলাদেশের