উপন্যাস নিরীক্ষণঃ শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮)-
----------------------------------
আজকের উপন্যাসঃ ক্রীতদাসের হাসি।
প্রকাশঃ রচনার দিক থেকে ক্রীতদাসের হাসি লেখকের তৃতীয় উপন্যাস। এর পুর্বেই ১৯৪২ সালে তার 'বনী আদম' এবং ১৯৪৪ সালে 'জননী' রচিত হয়। কিন্তু প্রকাশের দিক থেকে এটি তার দ্বিতীয় উপন্যাস কারণ তার প্রথম রচিত উপন্যাস 'বনী আদম' আরও অনেক পরে প্রকাশিত হয়। যাই হোক অনেকের মতেই লেখকের শ্রেষ্ঠ রচনার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই উপন্যাস প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে।
কাহিনীসূত্রঃ এই উপন্যাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো যখন যে প্রকাশনি থেকেই প্রকাশিত হোক না কেন প্রতিটি প্রকাশেই লেখক এই উপন্যাসের কাহিনীর উৎস ও তা আবিষ্কারের গল্প শুনিয়েছে। লেখকের ভাষ্যে জানা যায় যে তিনি তার দুই বন্ধুকে নিয়ে ছুটি কাটাতে গিয়ে একদিন বিপদে পড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের সহপাঠী রউফন নেসার বাড়িতে এবং স্বাক্ষাৎ পেয়েছিলেন বান্ধবীর দাদা শাহ ফরিদ উদ্দিন জৌনপুরির। এই দাদার কাছ থেকেই তারা প্রথমবারের মতো শুনেছিলেন আমাদের চিরপরিচিত আরব্য রজনী আসলে সহস্র ও এক রজনীর গল্প নয় বরং সহস্র ও দুই রজনীর গল্প। তারা সেখানেই দেখেছিলেন এর পান্ডুলিপি যা অনেক হাত ঘুরে বাগদাদ থেকে হিন্দুস্থান থেকে বাংলায় আসে। তারই সাথে লেখক জেনেছিলেন যে আরব্য রজনীর শেষ গল্প ১০১ নং তথা 'শাহজাদা হাবিবের গল্প' নয় বরং ১০২ নং তথা 'জাহাকুল আব্দ'। পরবর্তীতে এর বাংলা অনুবাদ করেন লেখক।
প্রেক্ষাপটঃ এই উপন্যাসের দৃশ্যমান গল্প হলো আব্বাসীয় খিলাপতের জগদ্বিখ্যাত খলিফা হারুন-অর-রশিদের খিলাফতের অত্যাচারের গল্প। তাই এটিকে দৃশ্যত ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে মনে হলেও আমরা জানি এটি প্রকৃত অর্থে একটি রূপক উপন্যাস। এর রচনাকাল (১৯৬২) হলো সেই সময় যখন এই বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শুধু সমগ্র পাকিস্তান ছিল সামরিক স্বৈর শাসক আইয়ুব খানের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অধীন। জনতার মত প্রকাশের স্বাধীনতার স্থলে অভিসিক্ত হয়েছিল স্বৈরতন্ত্রের বৈধতা লাভের কৌশলখ্যাত 'মৌলিক গণতন্ত্র'। সংবাদপত্র সমূহ একেরপর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, জুলুম নির্যাতন বাড়ছিল দ্রুত গতিতে। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তান সহ বিশ্বজুরে পূর্ববঙ্গের উপর তার স্বৈর শাসনকে লুকাতে তিনি রচনা করলেন 'Friends, not Master'। যেখানে তিনি বাঙালিদের ছেলে ভুলানো কথায় খুশি করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতা হরণ করে এই পুস্তক রচনায় তিনি বাঙ্গালিকে ভোলাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই অবস্থায় জাতীয় জীবন থেকে এই আবর্জনা সরাতেই লেখক কলমকে ব্যবহার করেছেন পরিষ্কারক তথা ঝাড়ু হিসেবে। অত্যন্ত সুন্দর করে আরব্য রজনীর ছদ্মবেশকে কাজে লাগিয়েছেন রূপক অর্থে। যেখানে অত্যাচারী, মানসিক বিকারগ্রস্ত খলিফা হারুনর রশিদ আইয়ুব খানের প্রতীক। অপরদিকে নির্যাতিত দাস তাতারী বাঙ্গালির প্রতীক। মজার বিষয় হল আইয়ুব খানের কথায় বাঙ্গালি না ভুললেও লেখকের কাছে পরাজিত হলেন আইয়ুব খান। তার উপন্যাসের মর্মার্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হয় পাকিস্তানি শক্তি। সে বার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে এই উপন্যাস-এর জন্য খোদ আইয়ুব খানের হাত থেকে আদমজী পুরস্কার গ্রহণ করেন লেখক। তাইতো তিনি বলছেনঃ
"জুয়াড়ির মত আমি দান ধরেছিলাম, হয় জয় নয় সর্বনাশ সুনিশ্চিত। জিতে গিয়েছিলাম শাসক শ্রেনির মূর্খতার জন্য। বছরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের পুরস্কার পায় ক্রীতদাসের হাসি।"
চরিত্র সমূহঃ
১. হারুনর রশিদঃ আব্বাসীয় খলিফা, উপন্যাসে আইয়ুব খানের প্রতীক।
২. তাতারীঃ খলিফার অসংখ্য দাসের মধ্যে একজন হাবশী দাস। হার না মানা বাঙালির প্রতীক।
৩. মেহেরজানঃ রাজমহিষী জোবায়দার সুন্দরী আর্মেনীয় দাসী, তাতারীর প্রেমিকা, পরবির্তীতে খলিফার বেগম। সাময়িক সুবিধাপ্রাপ্তিতে অতীত ভোলা বাঙালির প্রতীক।
৪. জোবায়দাঃ হারুনর রশিদের প্রধান বেগম তথা রাজমহিষী।
৫. মাশরুরঃ মূলত একজন দাস হলেও বর্ত্মানে খলিফার সেনাপতি, সহচর ও পরামর্শদাতা। সেইসব বাঙালির প্রতীক যারা রাজ অনুগ্রহের আশায় নিজের জাতীয়তাবোধ বিসর্জন দিয়েছে।
৬. অন্যান্য চরিত্রঃ ধামাধরা কবি আবুল আতাহিয়া, বিবেকের তাড়নায় পরিবর্তীত কবি আবু নওয়াস, দার্শনিক চরিত্রের আবু ইসহাক, বাগদাদের শ্রেষ্ঠ নর্তকী বুসায়না ইত্যাদি।
উপন্যাসের গল্পঃ
উপন্যাসের সময়ের ফ্রেম একটি হলেও দুটো ভিন্ন গল্প আলাদা ভাবে শুরু হয়ে একপর্যায়ে মিশে গেছে।
প্রথম গল্প খলিফা হারুনর রশিদের। আব্বাসীয় খিলাফতের এই সর্বজন পরিচিত খলিফা মুসলিম জাহানের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার পর থেকেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ভয়ে একে একে নিকটাত্মীয়সহ বিভিন্ন সম্ভাব্য সমস্যার কারন আমির ওমরাহদের হত্যা করছিলেন। এরই একপর্যায়ে তার দরবাররের উজিরে আজম তথা প্রধান মন্ত্রী আজম জাফর বার্মাকীর সাথে তার বোন আব্বাসার সম্পর্কের কারণে বোন ও জাফর উভয়কেই প্রাণদণ্ড দেন। এরপর থেকে খলিফা অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়েন একসময়ের সহোযোদ্ধাদের একে একে হত্যা করে খলিফা চরম একেকীত্বে ভুগতে থাকে। তার মনে কোন শান্তি থাকে না। এক সময় তার সেনাপতি মাশরুরের পরামর্শে রাতে বাগানে পায়চারি করতে করতে যান।
দ্বিতীয় গল্পটি হাবশী গোলাম তাতারী ও তার প্রেয়সী, আর্মেনীয় দাসি মেহেরজানের গল্প। এখানে দেখা যায় হাবিশী তাতারী ও মেহেরজানের বিয়ে হয় রাজমহিশী জোবায়দার জ্ঞ্যাতসারে এবং অনুমতিতে। তারই নির্দেশে প্রতিরাতে গোলামদের থাকার স্থানে মিলিত হত তাতারী ও মেহেরজান। দুজনের এই সান্নিধ্য দুজনকেই দেয় স্বর্গীয় অনুভুতি। আর এই অনুভুতিই তাতারীর কণ্ঠে ঝড় তোলে নির্মল হাসির।
এরপর থেকেই গল্পদুটি একই লাইনে মিশে গেছে। রাজ উদ্যানে পায়চারিরত খলিফার কানে আসে তাতারীর পরম সুখের স্বর্গীয় হাসি। খলিফার সুখেরলেশহীন হৃদয়কে আন্দলিত করে এই হাসি। মাশরুরের সহযোগিতায় হাসির উৎস খুজে বের করেন খলিফা এবং সেই হাসি বারংবার শোনার আশায় মুক্ত করে দেন তাতারীকে এবং মেহেরজানের স্থান হয় খলিফার হেরেমে। তার হাসিকে আরও প্রাণবন্ত করতে অল্পকাল পূর্বের দাস তাতারীকে দেয়া হয় বিপুল ঐশ্বর্য, সেবার জন্য প্রচুর দাস দাসী।
খলিফা তার রাজত্বে দাসের কণ্ঠের এই স্বর্গীয় হাসি শুনতে আহবান করেন কবি আবুল আতাহিয়া এবং কবি আবু নওয়াসকে এবং তাদের নিয়ে যান তাতারীর গৃহে। তাদের উপস্থিতিতে খলিফা তাতারীকে হাসার নির্দেশ দিলে হাসতে পারে না তাতারী। কারণ তার মূল শান্তির উৎস মেহেরজান থেকে খলিফা তাকে পৃথক করে দিয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে আমন্ত্রীত অতিথিদের সামনে তাতারীর নিরবতায় ক্ষিপ্ত হলেও পরক্ষনেই তাতারীর হাসতে না পারার কারণ অনুসন্ধান করে খলিফা তাকে খুশি করতে তার গৃহে প্রেরণ করেন বাগদাদের শ্রেষ্ঠ নর্তকী বুসায়নাকে যে তার সৌন্দর্যে মোহিত করেছে বাগদাদের সকল পুরুষকে। কিন্তু ফল হয় বিপরীত। বুসায়নাতো তাতারীর মনকে আন্দলিত করতে পারেই না উপরন্তু মেহেরজানের প্রতি তাতারীর ভালোবাসা এবং তাতারীর অনড় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে প্রভাবিত হয়ে নিজের জীবনকে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্ত খলিফাকে ক্রুদ্ধ করবে ভেবে ভিয়ে আত্মহত্যা করে সে।
আর পরাজয় মেনে নিতে না পেরে এইবার খলিফা পুরস্কার থেকে শাস্তির দিকে ধাবিত হন। বুসায়নার আত্মহত্যাকে হত্যা বলে তার জন্য দায়ী করে গ্রেপ্তার করা হয় তাতারীকে। চলে আমানুষিক নির্যাতন এবং বারংবার বলা হয় একবারের হাসি হতে পারে তার মুক্তির বিনিময়। কিন্তু অটল থাকেন তাতারী। এই অত্যাচার চলতে থাকে দীর্ঘ তিনটি বছর। কিন্ত মেহেরজানের বিচ্ছেদে হাসতে ভুলে যায় তাতারী।
অপরদিকে হেরেমের সুখ সাচ্ছন্দ্যে তাতারীর বিচ্ছেদ ভুলে খলিফার বেগমের জীবনকে সানন্দে গ্রহন করে মেহেরজান। শেষদৃশ্যে দেখা যায় সুসজ্জিতা মেহেরজান খলিফার আমন্ত্রনে দেখতে আসেন এক বন্দীর তামাশা। সে বন্দী আর কেউ নয়, তাতারী। প্রাথমিকভাবে চিনতে না পারলেও চেনার পর সে তাতারীকে বারবার হাসতে অনুরোধ করে। কিন্তু তাতারী হারায় তার জীবনের শেষ আশা। মেহেরজানকে বেগম হিসেবে দেখে সে বেঁচে থাকার শেষ কারণটুকু থেকে মুক্ত হয়ে যায়। তখনই আমরা তার কাছ থেকে পাই তার জীবনের শেষ বাক্যঃ
" শোন হারুনর রশিদ, দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস, গোলাম কেনা চলে, বান্দা কেনা সম্ভব, কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি না-না-না-না।"
এই বাক্যের সমাপ্তিতেই নিভে যায় তাতারীর জীবন প্রদীপ তার মুক্তি আসে দাসত্ব থেকে যদিওবা মৃত্যুর ছলে।
আলোচনা অনেক দীর্ঘ হয়ে গেল বিধায় এখানেই থামছি। যে কোন জিজ্ঞাসা বা পরামর্শ সাদরে গৃহীত ও বিবেচিত হবে।