------------------------
***রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর ‘শাটল ডিপ্লোমেসি’
১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশের অসহনীয় বোঝা। বলা যায় গলার কাঁটা। এই কাঁটা গেলাও যাচ্ছে না, ফেলাও যাচ্ছে না। কিন্তু এই কাঁটা না সরালে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। সেই ভয় ও আতঙ্কে আমাদের দিন কাটে। নিদারুণ এক অস্বস্তির মধ্য দিয়ে আমাদের সময় পার হয়।
রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে মারাত্মক সামাজিক সংকট তৈরি করছে। তারা অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তারা বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমাদের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে তাদের ব্যবহার করছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। দেশি-বিদেশি কিছু এনজিও-ও রোহিঙ্গাদের নিয়ে নানা খেলা খেলছে।
অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্রেফ মানবিক কারণে রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। এখন তাদের ফিরিয়ে নিতে অনীহা মিয়ানমার সরকারের।
মিয়ানমারের এই অনীহা কেন? রোহিঙ্গারা কি মিয়ানমারের (বার্মা) নাগরিক না? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রাখাইন প্রদেশে শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বসবাস করে আসছে। তারা সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে মিয়ানমারের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় রাখাইন অনেকটাই অবহেলিত। যোগাযোগব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
বলা যায়, মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ড থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন একটি এলাকা। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সেখানে বেশি। সংগত কারণেই তাদের ওপর মিয়ানমার প্রশাসনের দলন-পীড়ন ছিল মাত্রাতিরিক্ত। ঠুনকো অজুহাতে তাদের ওপর চলছিল নির্যাতন। রোহিঙ্গা মেয়েদের ওপর মিয়ানমার সেনাসদস্যদের পাশবিক নির্যাতনও চলে অহরহ। সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যার ঘটনা তো বিশ্ববাসীই দেখেছে।
জাতিসংঘই শুধু নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও বলেছে, রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে। এ অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে বিচারের দাবি উঠছে। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা মিয়ানমার সরকারের প্রধান অং সান সু চির সম্মাননা ও ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবিও উঠেছে।
বলা হচ্ছে, যিনি শান্তির জন্য নোবেল পেয়েছেন তিনিই চরম অশান্তি তৈরি করেছেন রাখাইনে! তাঁর সরকারের আমলেই বৌদ্ধদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলিমবিরোধী বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। এ কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। তার খেসারতও দিতে হচ্ছে বেশ কয়েকজন জেনারেলকে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জেনারেলকে ইউরোপ সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
তার পরও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আপত্তি জানাচ্ছে। তারা কোনো কিছুকেই গা করছে না। কারণ তাদের সঙ্গে আছে চীন। চীন যেন বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে রেখেছে মিয়ানমারকে; মিয়ানমারের অন্যায়কে ঢাকার নানামুখী প্রচেষ্টা করে আসছে। কিন্তু কেন?
রোহিঙ্গারা নতুন গজিয়ে ওঠা কোনো জাতি নয়। শত শত বছর ধরে তারা রাখাইনে বসবাস করে আসছে। তারা মিয়ানমারের সঙ্গেই আছে এবং ওই দেশের আইন-কানুন মেনে সেখানে থাকছে। তাহলে তাদের অপরাধ কী? তারা তো স্বাধীনতার জন্যও লড়াই করেনি। তারা বিদ্রোহও করেনি।
তাদের মধ্যে কিছু দুষ্কৃতকারী কিংবা সন্ত্রাসী থাকতে পারে। সেটা সব দেশেই আছে। তাই বলে একটি জাতিকে নিঃশেষ করে দিতে হবে! কেন তাদেরকে তাদের নিজস্ব আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হবে? চীন কেন রোহিঙ্গাদের রক্তের ওপর অর্থনৈতিক জোন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে!
রোহিঙ্গারা যাতে তাদের নিজস্ব আবাসভূমিতে ফিরে যেতে পারে সে জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা রকম কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জাতিসংঘে বিষয়টি উত্থাপন করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন। বিভিন্ন দেশে সফরে গিয়েও রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করেছেন। এখনো তা অব্যাহত আছে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার কারণে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ছাড়াও ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। ব্যক্তিগত সম্পর্ক যে রাষ্ট্রীয় সম্পর্কে প্রভাব ফেলে তার নজির আমরা অতীতে অনেকবার দেখেছি।
ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়েছেন। ভারতের সঙ্গে ৩০ বছরমেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে ভারতীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বড় ভূমিকা রেখেছে। তা ছাড়া স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণ ও ছিটমহল বিনিময় সমস্যা ঝুলে ছিল। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টিও ছিল অমীমাংসিত।
শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়েই ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন এবং তাতে তিনি সফল হন। ব্যক্তিগত সম্পর্ক না থাকলে দীর্ঘকালের জিইয়ে থাকা সমস্যার সমাধান করা সহজ হতো না।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ বিশ্বের অনেক সরকার ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে।
রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে থাকেন। এটি একটি দেশের জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। তা ছাড়া শেখ হাসিনা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবেও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের কাছ থেকে বিশেষ গুরুত্ব ও সম্মান পাচ্ছেন। এটা আমাদের দেশের জন্য বাড়তি পাওয়া।
বাঙালি জাতির জনক এবং অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে বিশেষ গুরুত্ব ও সম্মান লাভ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর কারণেই অনেক দেশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
১৯৭২ সালে ‘সৌদি আরব-চীন-পাকিস্তান’ বলয়ে থাকা দেশগুলোর স্বীকৃতি আদায় কিন্তু সহজ ব্যাপার ছিল না। ওই তিন দেশ স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের কাছে সব কিছুই হার মেনেছিল।
এবার জাপান সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুততর করতে জাপানি প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেছেন। শিনজো আবে দেরি করেননি। শেখ হাসিনা জাপান ত্যাগ করার পরপরই কূটনৈতিক পর্যায়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে দেশটি। ইতিমধ্যেই জাপান বলতে শুরু করেছে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে মিয়ানমারকে।
শেখ হাসিনা ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসিতেও রোহিঙ্গা ইস্যুটি তুলেছিলেন। ওআইসি প্রধানমন্ত্রীর পাশে থাকবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী ওআইসির আরো জোরালো ভূমিকা কামনা করেন। ওআইসি সক্রিয় হলে মিয়ানমারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী চীন সফর করবেন। চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিনি রোহিঙ্গা সংকটের বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। প্রধানমন্ত্রী খুব ভালো করেই জানেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের মূল কারিগর চীন। চীনকে ভালো করে ধরতে পারলে দ্রুতই এই সংকট সমাধান হবে। চীন চাপ দিলে দ্রুতই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার।
অনেকেই অবশ্য বলে থাকেন, মিয়ানমারে চীনের স্বার্থ আছে। সেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে চীন। নিজের স্বার্থ বিকিয়ে কিছুই করবে না চীন। কিন্তু বাংলাদেশেও তো চীনের স্বার্থ রয়েছে।
এখানেও তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ কম নয়। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেই চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সেই সম্পর্ক এখন অত্যন্ত সুদৃঢ়। শীর্ষ নেতৃত্বে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের বিপদে চীন পাশে দাঁড়াবে না—তা আমি বিশ্বাস করি না।
আমরা তো অতীতে দেখেছি, মিয়ানমারের যুদ্ধজাহাজ বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ঢুকে পড়েছিল। যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের আকাশসীমাও অতিক্রম করে। তখন বাংলাদেশ চীনের সহায়তা নিয়ে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। তবে এবারের মতো এত বড় সংকটে আগে কখনোই পড়েনি বাংলাদেশ।
এ সংকট মোকাবেলায় ভারতকেও পাশে রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরেও যেতে পারেন। আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন। এমন আভাসই দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তাঁর সংবাদ সম্মেলনে। দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক ঢাকা কিংবা দিল্লি যেখানেই হোক, বৈঠকে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় অন্যান্য ইস্যুর পাশাপাশি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টিকে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুততর করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ইমেজকে কাজে লাগালে বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করি। দেশের স্বার্থে তিনি তা করবেন বলে আমরা বিশ্বাসও করি।