##ন্যাম সম্মেলনে বাংলাদেশ যা পেল★★
আজারবাইজানের বাকুতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন তথা ন্যামের ১৮তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২৫-২৬ অক্টোবর। এ সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অংশগ্রহণ করেন। ১২০টি উন্নয়নশীল দেশের ফোরাম ন্যামের দু'দিনের সম্মেলনটিতে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে ন্যামের প্রতি আমাদের সমর্থন যেমন জোরালো হয়েছে, তেমনি সাংবিধানিক অঙ্গীকারও পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
আমাদের সংবিধানের ২৫নং ধারায় বলা হয়েছে, 'জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অপর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা- এসব নীতিই হবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি।' ঠিক একইভাবে ন্যামও প্রতিটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠা হয়। এমনকি আমাদের সঙ্গে ন্যামের সম্পর্কও ঐতিহাসিক। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ন্যামের কূটনৈতিক ভূমিকা ছিল।
১৯৭৩ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে বছর ৫-৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন-ন্যামের চতুর্থ শীর্ষ সম্মেলন। সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করতে ভূমিকা রাখে বঙ্গবন্ধুর সে সফর। বঙ্গবন্ধু সে সম্মেলনে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়তে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। সে সম্মেলন শেষে ঘোষণাপত্রে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের দেশগুলো তাদের সমর্থন দেয়।
এবারের ন্যাম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণের অর্জন অনেক। প্রথমত, আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রোহিঙ্গা সংকট। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনসহ এ সংকট সমাধানের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমর্থন ও সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ আমরা দেখেছি, মিয়ানমার বিষয়টি অগ্রাহ্য করে বারবারই পাশ কাটিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। অথচ রোহিঙ্গা সংকট তারাই সৃষ্টি করেছে।
বিশ্বের সব দেশ যদি মিয়ানমারকে জোর দিয়ে ধরে, সে ক্ষেত্রে দেশটি সবার কথা শুনতে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে সেটিই তুলে ধরেছেন। তিনি এও বলেছেন, এটি আঞ্চলিক সংকট। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে কোনো অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে তার প্রভাব গোটা অঞ্চলেই ছড়িয়ে পড়বে। তাছাড়া মানবিক দিক বিবেচনায়ও তাদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা দরকার। রোহিঙ্গারা এখন নাগরিকত্বহীন।
যে কোনো মহল তাদের ব্যবহার করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। এর আগে সেপ্টেম্বরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আসর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনেও তিনি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তুলে ধরেন। এবারের ন্যাম সম্মেলনের আগে ভারতে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে।
বৈশ্বিক ফোরামে এসব পুনঃপুন বক্তব্যের মাধ্যমে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান ভাবতে শুরু করেছে। আমরা মনে করি, বিশ্বের প্ল্যাটফর্মে অংশগ্রহণ দেশকে তুলে ধরা বড় সুযোগ। ন্যাম বা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলন সেদিক থেকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলনে যোগদান, সংস্থাটির কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকার বরাবরই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। সেটি বাংলাদেশের স্বার্থেই প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থরক্ষায় ন্যাম বরাবরই ভূমিকা পালন করে এসেছে।
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখা, জাতিবিদ্বেষ দূরীকরণ, বৃহৎ শক্তির চাপে পরে বহুপক্ষীয় সামরিক চুক্তি করায় বাধ্য হওয়া থেকে রক্ষা করা, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যে কোনো ধরনের অবরোধ-হুমকি এড়ানো ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে ন্যাম অতীতে ভূমিকা পালন করে এসেছে।
১৯৯০ সালে দুই পরাশক্তির স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়েও এখন কিন্তু শেষ হয়নি। এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এমনকি চীনও তার প্রভাববলয় গড়ে তুলছে। আর ন্যাম সব বলয়ের বাইরে গিয়ে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী সদস্য দেশগুলোকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখানো, বহির্শক্তির প্রভাব থেকে রক্ষা করা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ বন্ধ করার কাজ করে যাচ্ছে।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ন্যাম সম্মেলনে যোগদানের পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই ন্যামের ব্যাপারে আগ্রহী হয়। এমনকি ২০০৯ সালে ন্যামের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়।
অথচ আমরা জানি, ১৯৯৬ সালের পর ক্ষমতা পরিবর্তনের ফলে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের ত্রয়োদশ সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তৎকালীন সরকার অপারগতা প্রকাশ করলে সম্মেলন পিছিয়ে যায় এবং ২০০৩ সালের ২০-২৫ ফেব্রুয়ারি সে সম্মেলন মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হয়।
এবারের ন্যাম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর যোগদানের ফলে রোহিঙ্গা বিষয়টি যেমন গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে, তেমনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নেও সম্মেলনটি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে বলে আমরা মনে করি। প্রধানমন্ত্রী মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন।
মালয়েশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়াকে আমাদের পাশে থাকা চাই। ন্যাম সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রীর ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, নেপাল, ফিলিস্তিনি নেতৃবৃন্দসহ বেশ কয়েকজন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক বাংলাদেশের কূটনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে নিঃসন্দেহে।
তাছাড়া সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদারে বাংলাদেশ ও আজারবাইজানের মধ্যকার চুক্তিও এ সম্মেলনের অন্যতম প্রাপ্তি। ফিলিস্তিন তাদের হেবরন শহরের একটি সড়ক বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আমরা জেনেছি। ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবারের ন্যাম সম্মেলনের ফাঁকে বাকু কংগ্রেস সেন্টারে দ্বিপক্ষীয় বুথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে এ কথা বলেন। ফিলিস্তিনি নেতা এই সড়কের নামফলক উন্মোচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণও জানান।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলছে। আমরা বিশেষ করে গত এক দশকে দেখে আসছি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কীভাবে প্রতিবেশীসহ বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছেন। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের স্পিরিটও এটিই। সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
আমরা মনে করি, ন্যাম আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্তমানে বিশ্বে যে বৈষম্য রয়েছে, তা নিরসনে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিশ্বের পরিবেশ, দারিদ্র্য নিরসন করে নানামুখী প্রভাববলয়ের বাইরে এসে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখা এবং বিদ্যমান বৈশ্বিক সমস্যা যারা জিইয়ে রাখছে, তাদের চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের এ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণ সংস্থাটির প্রতি আমাদের আস্থার প্রতিফলন। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক তাতে আমরা মনে করি, সংস্থাটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগও তৈরি করেছে। বৈশ্বিক প্রয়োজনে এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ যেমন আমাদের পররাষ্ট্রনীতির পরিচায়ক, তেমনি বৈশ্বিক বাস্তবতায়ও গুরুত্বপূর্ণ।