##চীনা প্রেসিডেন্টের দক্ষিণ এশিয়া সফর
★আঞ্চলিক সম্পর্ক
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার দক্ষিণ এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে ভারত সফর শেষ করেছেন গত ১২ অক্টোবর। এরপর তিনি যান নেপালে। এর আগে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে বেইজিংয়ে বৈঠকে মিলিত হন। চীনের প্রেসিডেন্টের ভারত সফর কোনো রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। এশিয়ার দুটি বড় অর্থনীতির দেশ ভারত ও চীনের নেতারা গত দুই বছর ধরে এভাবে 'অনানুষ্ঠানিক' বৈঠকে মিলিত হয়ে আসছেন। এর আগে চীনের উহানে ২০১৭ সালের গ্রীষ্ফ্মে দুই নেতা মিলিত হয়েছিলেন।
বলা হচ্ছে 'Wuhan Spirit'-এর আলোকেই তামিলনাড়ূর মমল্লপুরমে দুই নেতা অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হলেন। কিন্তু তুলনামূলক বিচারে তার নেপাল সফরের গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। তবে চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরকেও হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেননা এই সফরটি অনুষ্ঠিত হলো এমন এক সময়ে, যখন কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে উত্তেজনা বাড়ছে; চীন-কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানকে সমর্থন করছে এবং পাকিস্তানকে সব ধরনের সাহায্যের কথা বলছে।
এ মুহূর্তে চীনের কাছে পাকিস্তানের গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে চীন বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৬২ মিলিয়ন ডলার, যা চীনের কাসি (Kashi) থেকে বেলুচিস্তানের গাওদার গভীর সমুদ্রবন্দরকে সংযুক্ত করেছে। এই অর্থনৈতিক করিডোরটি (সড়ক ও রেল যোগাযোগ) পাকিস্তান অধিকৃত আজাদ কাশ্মীরের ওপর দিয়ে গেছে, যেখানে ভারত তার আপত্তি জানিয়ে রেখেছে।
কাশ্মীর প্রশ্নে চীনের পাকিস্তানকে সমর্থক করার পেছনে কাজ করছে চীনের এই স্ট্র্যাটেজি। ফলে শি জিনপিংয়ের ভারত সফরের সময় সবার দৃষ্টি ছিল কাশ্মীর প্রশ্নে দুই নেতা কোনো কথা বলেন কি-না, তা দেখা। কিন্তু কাশ্মীর প্রশ্নে কোনো কথা হলো না। দুই প্রতিবেশী দেশ সিদ্ধান্ত নিল, বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ দমনে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়বে। আর বাণিজ্য, যোগাযোগ, পর্যটন ও সাংস্কৃতিক বিনির্মাণের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করে তুলবে চীন ও ভারত।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি উক্তি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়। তিনি বলেছেন, উহানের শীর্ষ সম্মেলন ভারত ও চীনের পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্পর্ককে জোরদার করতে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। আর চেন্নাইয়ের ওই বৈঠকে (চেন্নাই কানেক্ট) দুই দেশই পারস্পরিক সম্পর্কে একটি নতুন যুগ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্টও বলেছেন, 'নতুন যুগ শুরু হলো দুই দেশের সম্পর্কে।'
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অনানুষ্ঠানিক এই বৈঠকটি ছিল যথেষ্ট আন্তরিকতাপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী মোদি চীনা প্রেসিডেন্টকে অর্জুনের তপস্যা, কৃষ্ণের বাটারবল, পঞ্চরথ ও মন্দিরের ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো ঘুরে দেখান। চীনা প্রেসিডেন্ট বলেন, তামিলনাড়ূর সঙ্গে চীনের পারস্পরিক মতবিনিময় এবং সমুদ্র বাণিজ্য নিয়ে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
সেই ইতিহাসকে এমনভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, যাতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিকাশ আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়, আর তা এশীয় সভ্যতার পক্ষে নতুন গৌরবের হয় (আনন্দবাজার)। এখন যে প্রশ্নটি সঙ্গত কারণেই উঠবে তা হচ্ছে, এই যে সম্পর্কের 'নতুন পর্বের' কথা বলা হচ্ছে কিংবা 'এশীয় সভ্যতার পক্ষে নতুন গৌরবের' কথা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবে কতটুকু রূপ পাবে? কিংবা ভারত ও চীন তাদের মধ্যকার বিবাদ মিটিয়ে কতটুকু কাছাকাছি আসতে পারবে?
চীনের বিশ্বদর্শন কিংবা দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন ও ভারত এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়েছে। চীন তার 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড'-এর যে মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, ভারত তা সন্দেহের চোখে দেখছে। এর বিকল্প হিসেবে ভারতের নিজস্ব চিন্তাধারা হচ্ছে- প্রাচীন 'কটন রুট'কে পুনরুজ্জীবিত করা, সেই সঙ্গে 'ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি'তে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। ভারত একই সঙ্গে Quadrilateral Security Dialogue (অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র অপর সদস্য) এরও অংশীদার। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের সামরিক অংশগ্রহণ চীনের প্রতি সরাসরি এক ধরনের চ্যালেঞ্জের শামিল। পর্যবেক্ষকরা অনেক দিন ধরেই ভারত মহাসাগরবর্তী অঞ্চলে এক ধরনের চীন-ভারত দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করে আসছেন। এ অঞ্চল ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা যে স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর আশঙ্কা করছেন, তা শুরু হতে পারে ভারত মহাসাগরে প্রভাববলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে। এ ক্ষেত্রে চীন অনেকটা একা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মৈত্রী চীনের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করছে। ফলে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব কোনদিক যায়, সেদিকে লক্ষ্য আছে অনেকের।
বলতে দ্বিধা নেই, বেশ কিছু ইস্যুতে চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্ব বর্তমান। ২০১৭ সালের দোকলাম ঘটনায় এই দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও পরবর্তীকালে এই উত্তেজনা কিছুটা হ্রাস পায়। অরুণাচল প্রদেশের ওপর থেকে চীন তার দাবি পরিপূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেনি। কাশ্মীর প্রশ্নেও ভারতের বিরুদ্ধে চীনের অবস্থান।
ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদের অন্যতম দাবিদার। কিন্তু চীনের এখানে আপত্তি রয়েছে। ভারত পারমাণবিক শক্তি ও পারমাণবিক সাপ্লাইয়ার্স গ্রুপের সদস্য হতে চায়। এখানেও আপত্তি চীনের। ভারত-চীন বাণিজ্য সাম্প্রতিককালে অনেক বেড়েছে; কিন্তু তা ভারতের প্রতিকূলে।
অর্থাৎ চীন ভারতে রফতানি করে বেশি, ভারত থেকে আমদানি করে কম (চীনে ভারতের রফতানি ১৬.৩৫ বিলিয়ন ডলার আর চীন থেকে আমদানি ৬৮.০৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭)। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান চীনের প্রভাব ভারতের জন্য চিন্তার কারণ। শ্রীলংকায় (হামবানতোতা গভীর সমুদ্রবন্দরে চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতি) কিংবা মালদ্বীপে চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ভারত তার নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে।
এ কারণেই বাংলাদেশে সোনাদিয়ায় চীন যে গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করতে চেয়েছিল, তা ভারতের আপত্তির মুখে শেষ পর্যন্ত এ সংক্রান্ত চুক্তিটি আর বাংলাদেশ সই করেনি। যদিও চীনের জন্য সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। চীন বিকল্প হিসেবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে Kyaukphyuতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনা জ্বালানি তেল এই বন্দরে খালাস করে তা সড়ক ও রেলপথে ইউনান প্রদেশে নিয়ে যাচ্ছে।
সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হলে চীন বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার) করিডোরটি (সড়কপথ) ব্যবহার করে তার পণ্যের রফতানি অতি দ্রুততার সঙ্গে এই বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে পারত। বাংলাদেশ পিছিয়ে যাওয়ায় বিসিআইএমের আওতায় যে সড়কপথ নির্মিত হওয়ার কথা ছিল, তাতেও এসেছে এক অনিশ্চয়তা। এদিকে নেপালে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় তা ভারতকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
ভারতের ওপর নেপালের নির্ভরশীলতা এবং এই নির্ভরশীলতা ভারত তার নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার কারণে নেপাল ধীরে ধীরে চীনের দিকে ঝুঁকছিল। ভারত অতীতে একাধিকবার নেপালে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় সেখানে সংকট তৈরি করেছিল। নেপালের বিপুল অর্থনৈতিক চাহিদা নেপালকে চীন-নেপাল অর্থনৈতিক করিডোর গঠনে উৎসাহিত করেছিল।
এই অর্থনৈতিক করিডোরের আওতায় লাসা (তিব্বত)-খাসা ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে ভারতের ওপর থেকে নেপাল তার নির্ভরশীলতা অনেক কমাতে পারবে। আরেকটি পরিকল্পনা হচ্ছে- চীনের কিনঘি (Qinghi) প্রদেশের গলমুদের (Golmud) সঙ্গে তিব্বতের লাসা রেল সংযোগ স্থাপন। এতে করে তিব্বতকে চীনের অর্থনীতির আওতায় আনা সম্ভব হবে। এতে নেপালও সুবিধা পাবে। চীন নেপালের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে সহায়তা করছে এবং দেশটিকে ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তাও দিয়েছে।
নেপাল চীনের ওবিওআর (OBOR) মহাপরিকল্পনায়ও যোগ দিয়েছে। ভুটানেও চীনের প্রভাব বাড়ছে। চীনের সঙ্গে ভুটানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। সেখানে ভারতের প্রভাব বেশি। দোকলাম নিয়ে সীমান্ত সমস্যা (ভুটানের সঙ্গে) কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে চীন। এটা ভারতের স্ট্র্যাটেজিস্টরা খুব ভালো চোখে নেবেন না। সুতরাং একটা প্রশ্ন থাকবেই, 'চেন্নাই কানেক্ট' দুই দেশের সম্পর্ক জোরদারে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখবে কি-না? নাকি শুধুই একটি 'ফটোসেশন'?
ভারত ও চীন দুটিই বড় অর্থনীতির দেশ। ২০৩০ সালে ২২.২ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হবে চীনের (২০৫০ সালে পিপিপিতে এটা গিয়ে দাঁড়াবে ৫৮.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে)। তখন বিশ্বের ১ নম্বর অর্থনীতি হবে চীনের। অন্যদিকে ২০৩০ সালে ভারতের অর্থনীতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫.৬ ট্রিলিয়ন ডলার (তৃতীয়) আর পিপিপিতে ২০৫০ সালে এটা গিয়ে দাঁড়াবে ৪৪.১ ট্রিলিয়ন ডলার (দ্বিতীয়)। পিপিপিতে (২০১৬) চীনের অবস্থান দেখানো হয়েছে প্রথম আর ভারতের তৃতীয়।
যদিও জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে চীন কিছুটা পিছিয়ে আছে। যেখানে (২০১৮) চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.৯, সেখানে ভারতের ৭.৩। এই দুটি দেশে রয়েছে বিপুল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে চীনের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। ভারত এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে কিছুটা। সুতরাং প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তা বদলে দেবে পুরো বিশ্বকে।
কিন্তু দেশ দুটি যদি তাদের আগ্রাসী মনোভাব অব্যাহত রাখে, তাহলে সম্পর্ক উন্নত হবে না। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে নিয়ে এক ধরনের Containtment Policy অবলম্বন করছে। অর্থাৎ চীনকে দুর্বল করা। একসময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে এই Containtment Policyঅবলম্বন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন দৃশ্যপটে আছে চীন। এ ক্ষেত্রে ভারত বড় শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার রয়েছে স্ট্রাটেজিক্যাল অ্যালায়েন্স। এই স্ট্র্যাটেজিক্যাল অ্যালায়েন্স যদি চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহূত হয়, তাহলে চেন্নাই কানেক্ট কাজ করবে না। এখন দেখার পালা, এই সম্পর্ক আগামী দিনে কোন দিকে যায়।