যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রহণযোগ্য শর্তের কারণে মে মাসের শেষ দিকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা ভেঙে যায়। ২০১৭ সালের এপ্রিলে ফ্লোরিডায় ট্রাম্পের নিজস্ব এস্টেটে এ বিষয়ে বৈঠক করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং।
এরপর দুই পক্ষের মধ্যে আরো ১০ দফা বৈঠক হয়েছে। কিন্তু বিরোধের মূল বিষয়গুলোর নিরসন হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাকে অগ্রাহ্য করার ঠুনকো অভিযোগে চীনের টেক-জায়ান্ট হুয়ায়েই এবং এর ৭০টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে ট্রাম্প প্রশাসন। ফলে দুই দেশের বিরোধ আরো বাড়ে। আলোচনা চলা অবস্থায় শুল্ক প্রত্যাহারের ব্যাপারে ট্রাম্পের অস্বীকৃতির ফলও একই হয়েছে, মূল বিষয়ে বিরোধ আরো বেড়েছে। এক বছর আগে দ্বিপক্ষীয় দেনদরবার শুরুর সময় বিরোধ যা ছিল, এখন তা বেড়ে আকাশ সমান।
বেইজিং বলেছে, ওয়াশিংটনের ইচ্ছার কাছে মাথানত করার জন্য চাপ দিয়ে, আবোলতাবোল বলে বোকা বানানোর চেষ্টা করে, অবজ্ঞা করে বা হুমকি দিয়ে লাভ নেই। সব পক্ষের জন্য মঙ্গলজনক হলেই শুধু সমঝোতায় পৌঁছানো যেতে পারে।
ট্রাম্পের বাণিজ্য প্রতিনিধি রবার্ট লাইটহাইজার জানিয়েছেন, উভয় পক্ষ বাণিজ্য আলোচনা আবার শুরু করতে সম্মত হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী মনুচিন ও তিনি এবং চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান আলোচক লিউ হে জাপানের ওসাকায় বৈঠকে বসবেন। সেখানেই জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। গত মঙ্গলবার ট্রাম্প জানিয়েছেন, ২৮-২৯ জুন জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। দুই পক্ষের সংশ্লিষ্ট টিম ওই বৈঠকের আগেই আলোচনায় বসবে।
বৈঠকে বেশ কিছু দ্বিপক্ষীয় মতভেদ নিয়ে কথা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে বৈঠকের এজেন্ডার ব্যাপারে কোনো পক্ষই কিছু জানায়নি। মঙ্গলবারই শি ও ট্রাম্প ফোনে কথা বলেছেন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লু কাং জানিয়েছেন, দুই নেতা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করবেন। চীনের সাবেক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ওয়েই চিয়াংগুয়ো বলেছেন, শি বেইজিংয়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মূল বিষয়গুলোতে জোর দিয়ে কথা বলবেন। তবে কোনো সমঝোতা স্মারক সম্পন্ন হবে বলে মনে হয় না।
গত বছর যেসব বিষয় অনিষ্পন্ন ছিল, সেগুলোর নিষ্পত্তির জন্য উভয় পক্ষের আলোচকদেরই উপায় খুঁজতে হবে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন কঠোর অবস্থানে থাকলে কোনো কিছুতেই পরিবর্তন আসবে না। ট্রাম্প-শি সর্বশেষ মুখোমুখি বৈঠকে বসেছিলেন গত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সময়, আর্জেন্টিনার বুয়েনেস আয়ারসে। তখন তাঁরা ৯০ দিনের ‘যুদ্ধবিরতি’তে সম্মত হয়েছিলেন ব্যাপক মতভেদের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত সমাধানের লক্ষ্যে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
মূল বিষয়গুলোর ব্যাপারে মতভেদ নিরসন সম্ভব না হলেও ওসাকা বৈঠকের ফলাফলের ব্যাপারে উভয় নেতাই সন্তুষ্টির মনোভাব দেখাবেন। জানা গেছে, মঙ্গলবারের আলাপের সময় শি ট্রাম্পকে বলেছেন, তিনি আশা করেন ওসাকা বৈঠকে নেতিবাচক প্রভাববিস্তারি মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হোক।
যুক্তরাষ্ট্র চীনকে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী ও শীর্ষ প্রতিপক্ষ মনে করে। দুই দেশের সম্পর্ক যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে পারস্পরিক সহযোগিতা বলতে যা বোঝায় তা দূর-অস্ত্। মতভেদের বড় বিষয়গুলোর সুরাহা না হওয়ার কারণ ওয়াশিংটনের একগুঁয়েমি, অন্য সব জাতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা। তারা চায়, সব রাষ্ট্র সার্বভৌমত্বের অধিকার বিসর্জন দিয়ে তাদের স্বার্থের কাছে মাথানত করুক। এ মনোভাব বেইজিংয়ের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিপক্ষীয় বিরোধ থেকে যাওয়ার কারণ যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতি, শিল্প ও প্রযুক্তি খাতে চীনের অগ্রযাত্রা, সমকক্ষ হয়ে ওঠা বা অতিক্রম করে যাওয়ার প্রয়াসকে মেনে নিতে রাজি নয়। বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি এ ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।
ওসাকায় শি-ট্রাম্প বৈঠক এবং প্রধান আলোচকদের আলোচনার পুনঃ সূচনা অনিরসিত বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি করবে কি? চীনের গ্লোবাল টাইমস পত্রিকায় বলা হয়েছে, বেইজিংকে অবশ্যই দৃঢ়চিত্ত হতে হবে, দমে গেলে চলবে না। ওয়াশিংটনকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে, চীনকে দমিয়ে রাখা যাবে না। তারা যদি অন্যায্য শর্ত চাপিয়ে দেয়, তাহলে তার ফল ভোগ করার প্রস্তুতিও তাদের রাখতে হবে।
চীনের সরকারি মুখপত্র পিপলস ডেইলিতে বলা হয়েছে, চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধের কারণ চীন নয়; বরং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিপ্রসূত উচ্চাভিলাষ পূরণ করার মার্কিন চেষ্টাই এর কারণ। চীন বাণিজ্যযুদ্ধ চায় না, তবে মোকাবেলা করতে মোটেই ভীত নয়।
বাণিজ্য আলোচনাবিষয়ক অচলাবস্থা ওসাকার বৈঠকে মিটে যাবে তেমন সম্ভাবনা খুবই কম। মতভেদের বড় ইস্যুগুলোর সমাধান যুক্তরাষ্ট্রের নমনীয় হওয়ার ওপর নির্ভর করছে। আগামী কয়েক সপ্তাহ বা মাসে তেমনটি ঘটবে কি না প্রবল সন্দেহ রয়েছে।