মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোহাম্মদ মুরসিকে ইতিহাস স্মরণে রাখবে। মুরসির মৃত্যু অনেক অর্থ বহন করে। কেউ চাইলে সাদামাটাভাবে দেখতে পারেন। মুরসি অসুস্থ ছিলেন। মারা গেছেন।
কিন্তু মুরসির মৃত্যু অন্য অর্থও বহন করে। যেমন বরার্ট ফিস্ক বলেছেন, মুরসির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মিসরীয় গণতন্ত্রেরও মৃত্যু হয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, গোটা আরবের গণতন্ত্রেরই মৃত্যু হলো।
মুরসি অনেকের জন্যই শিক্ষা। কেউ যদি মিসরে গণতন্ত্রের কথা বলেন, ইসরায়েলি স্বার্থের বিরুদ্ধে যান, তবে মুরসির মতোই পরিণতি নিশ্চিত। আরবের অন্যান্য দেশের জন্যও এটা প্রযোজ্য। ইসরায়েলের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই মুরসির মতো মৃত্যু।
আরব বসন্তের ঢেউয়ে মুরসি রাজনীতির ময়দানে সামনে চলে এসেছিলেন। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে মুরসিকে সারা বিশ্ব তেমন চিনত না। হতে পারে ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পর্কিত রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা তাঁকে জানতেন।
২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার পরপরই মুরসি আলোচনায় আসেন এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিরুদ্ধপক্ষের ব্যাপক সমালোচনার শিকার হতে থাকেন। মুরসি মিসরকে ইরানের ধাঁচে ইসলামিক রিপাবলিকে পরিণত করবেন। শরিয়াহ আইন চালু করবেন। নারীর অধিকার থাকবে না।
গণমাধ্যমের অধিকার থাকবে না। মুরসি বিচারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। ইত্যাকার অভিযোগ তুলে মুরসির বিরুদ্ধে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়। সঙ্গে যোগ দেন মিসরের প্রগতিশীল ব্যক্তিরা। মোদ্দাকথা, পশ্চিমা প্রগতিশীলতার নিক্তিতে মুরসি উত্তীর্ণ হতে পারেননি।
আদালতে আসামির খাঁচায় রাখা হয় তাঁকে। ছবি: রয়টার্স
এটা ঠিক, মুরসি মিসরকে ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারেননি। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি ছিল। একের পর এক কপটিক ক্রিশ্চিয়ানদের গির্জায় হামলা হয়েছে। অবশ্য কেউ কেউ বলে থাকেন, মুরসির বিরুদ্ধে জনসাধারণকে খেপিয়ে তুলতে সৌদির অর্থ ও ইসরায়েলের তত্ত্বাবধানে এসব হামলা হয়েছে।
এতে মিসরীয় গোয়েন্দা সংস্থার একাংশও জড়িত ছিল। মুরসির ব্যর্থতা হচ্ছে, গির্জায় হামলা বন্ধ করতে পারেননি। অভিযোগ রয়েছে, মুরসি বিচার বিভাগে ব্রাদারহুডের লোকজন ঢুকিয়ে দখলের চেষ্টা করছিলেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতেও ব্রাদারহুডের লোকজনকে নিয়োগ দিচ্ছিলেন।
তবে মিসরের অনেকেই মনে করেন, মুরসির আমলে গণতন্ত্র, বাক্স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানের থেকে অনেক অনেক ভালো ছিল। মুরসি সব থেকে বেশি সমালোচিত হয়েছেন এক সাংবাদিককে আদালতে তুলে। ওই সাংবাদিক টিভি অনুষ্ঠানে মুরসিকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছিলেন।
প্রগতিশীলরা অভিযোগ করেন, মুরসি ইরানের খোমেনির মতোই বিপ্লব ছিনতাই করেছেন। কিন্তু ইরানের মতোই প্রগতিশীলেরা চিন্তা করেন না, কেন তাঁরা ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় হতে পারছেন না। ভোটের মাঠে পারলাম না, আমরা ক্ষমতায় যেতে না পারলে ব্রাদারহুডকে ক্ষমতায় থাকতে দেব না, অনেকটা এমন মনোভাব নিয়েই প্রগতিশীলেরা মাঠে নামেন। অভিযোগ রয়েছে, মিসরের প্রগতিশীলেরা ইসরায়েল-মার্কিন-সৌদি সহায়তায় এসব বিক্ষোভের আয়োজন করেন।
মুরসি তো মরেই গেছেন। ব্রাদারহুডও আর মিসরের ক্ষমতায় নেই। কিন্তু মিসরের সেই সব প্রগতিশীল এখন কী করছেন? যাঁরা তাহরির স্কয়ারে সমবেত হয়ে মুরসির বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানকে উসকে দিয়েছিলেন। জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ সিসির আমলে এখন মুরসির সময় থেকে বেশি সাংবাদিক জেলে। মিসরে জেলখানাগুলো এখন আসামিতে টইটুম্বুর। বিরুদ্ধমতের সবাইকেই জেলে পোরা হচ্ছে। গুম সেখানে নিত্য ঘটনা। টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
সিসির বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ তো দূরের কথা, সাধারণ সমালোচনা করারও সুযোগ কারও নেই। ব্রাদারহুডকে ঠেকাতে গিয়ে মিসরের প্রগতিশীলেরা এখন ইসরায়েলের কাছে বশীভূত। প্রগতিশীলদের নড়াচড়া খুব বেশি চোখে পড়ছে না মিসরে।
মুরসির শাসনকাল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মৃত্যু অনিবার্য ছিল মুরসির জন্য। মুরসি ফিলিস্তিন বিশেষ করে গাজাবাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। হামাসের সঙ্গে তার সখ্য ছিল, মার্কিন-ইসরায়েল-সৌদি জোটের কাছে যা বিরাট অপরাধ। হামাসের সঙ্গে আঁতাত করে মিসরে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অভিযোগে বিচার চলাকালেই মুরসি আদালতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীল কেউ মিসরের ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। কারণ, মিসরের ভৌগোলিক অবস্থান ইসরায়েলের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিসরকে বাগে রাখতে পারলে গাজা পুরোটাই ইসরায়েল দখল করতে পারে। অন্তত হামাসকে দুর্বল করে দেওয়া যাবে, গাজার ওপর অবরোধ অব্যাহত রাখা যাবে। কেননা মিসর সীমান্ত বন্ধ না করলে ইসরায়েলের গাজা অবরোধ ব্যর্থ হয়।
মিসরের পতিত স্বৈরশাসক মোবারক আদালতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন। ছবি: রয়টার্স
অথচ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই মুরসি মিসরের সঙ্গে গাজার রাফাহ সীমান্ত খুলে দেন। এই রাফাহ সীমান্ত দিয়েই হামাস নেতা খালেদ মেশাল কয়েক দশক পর গাজা সফর করেন, যাঁকে কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করে ইসরায়েল বিফল হয়েছে। এ ছাড়া মিসরে ইসরায়েল দূতাবাসেও বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা করে। এটা ইসরায়েল কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি।
এসব ঘটনা মুরসির ক্ষমতাচ্যুতি ও মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে। ১৯৭৯ সালে মিসর-ইসরায়েল শান্তিচুক্তি অনুসারে মিসর গাজার রাফাহ সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। ওই চুক্তিতে মিসর ও ইসরায়েলের সম্পর্কে শান্তি স্থাপিত হলেও গাজাবাসীর জীবনে নেমে আসে চরম অশান্তি। রাফাহ সীমান্ত উন্মুক্ত হলে গাজাবাসী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মিসর থেকে সহজেই আমদানি করতে পারে।
অন্যথায় গাজা-ইসরায়েল সীমান্তের কেরেম সাহলম সীমান্ত দিয়ে আমদানি করতে হয়। কার্যত এই সীমান্ত ইসরায়েল বন্ধই রাখে। ইসরায়েলের লক্ষ্য, অবরোধ আরোপ করে গাজাবাসীকে নিঃশেষ করে দেওয়া। রাফাহ সীমান্ত বন্ধ করে দিলে ইসরায়েলের ইচ্ছার ষোলোকলা পূর্ণ হয়। দীর্ঘ সময় ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মিসরের শাসকেরা এই কাজটিই করছিলেন।
কিন্তু মুরসি ক্ষমতায় এসে রাফাহ সীমান্ত বিষয়ে বাগড়া দিয়ে বসেন। এ বিষয়ে মার্কিন-ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ১৯৭৯ সালের চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলেও মুরসি কথা শোনেননি।
১৯৭২ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে মার্কিন ও ইসরায়েলের পুতুল শাসকেরাই মিসরের ক্ষমতায় ছিলেন। বিপরীত স্রোত থেকে মুরসি আসায় তাঁকে হটাতে মার্কিন-ইসরায়েল জোট সক্রিয় হয়ে যায়। এদের সঙ্গে যোগ দেয় সৌদি আরব। সৌদি মূলত দুটি কারণে মুরসির বিপক্ষে।
প্রথমত, মুরসি কাতার, ইরান ও তুরস্কের সমন্বয়ে নতুন এক আঞ্চলিক রাজনৈতিক বলয় সৃষ্টির জন্য সক্রিয় ছিলেন। দ্বিতীয়ত, আশঙ্কা ছিল ইরান, তুরস্ক ও মিসর মিলে সৌদির গণতান্ত্রিক আন্দোলন উসকে দিতে পারে।
মূলত মুরসির বিরুদ্ধে মার্কিন, ইসরায়েল, সৌদি আরব, প্রগতিশীল, নারীবাদী সব পক্ষ নিজ নিজ স্বার্থের জায়গা থেকে এক হয়ে গিয়েছিল। সবাই মিলে মুরসিকে হটিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে আরব থেকে গণতন্ত্রকেও নির্বাসনে পাঠিয়েছেন।
ইসরায়েলকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম কাজ হচ্ছে আরবে গণতন্ত্রকে স্তব্ধ করে দেওয়া। এটা নিশ্চিত, আরবের অধিকাংশ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে ইসরায়েলের টিকে থাকা মুশকিল হবে। তাই মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে অনেক পাখি মারা হলো। কখনোই গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করা যাবে না।
ইসরায়েলের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া যাবে না। যদি কেউ যান, তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত। মিসরের মতো দেশ হলে তা অনিবার্য। বিশেষ করে যখন কোনো দেশের গণমাধ্যম, প্রগতিশীল সমাজ, শিক্ষিত শ্রেণি জাতীয় স্বার্থের চেয়ে নিজ নিজ মতাদর্শ ও স্বার্থকে বড় করে। মুরসি পপুলার ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু এরপরও মুরসি রাজনৈতিক ‘হত্যারই’ শিকার হলেন।