গত কয়েকমাস থেকেই আমেরিকা ও ইরানের মধ্যকার উত্তেজনার প্রেক্ষিতে উত্তপ্ত হয়ে আছে পারস্য উপসাগরীয় এলাকা। যদিও দুই দেশের সাম্প্রতিক উত্তেজনার সূত্রপাত হয় গত বছরের ১০ মে থেকে। সে সময় আমেরিকা ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত ছয়পক্ষীয় পরমাণু চুক্তি থেকে একতরফাভাবে সরে আসে।
ঐ ঘটনার পর দেশটি ইরানকে একঘরে করার নীতি অবলম্বন করে। তেহরানের উপর নানা ধরনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে আমেরিকা দেশটির জ্বালানি রপ্তানি সীমিত করতে প্রচেষ্টা চালায়।
আমেরিকার এই তত্পরতাকে ইরান অর্থনৈতিক আগ্রাসন হিসেবে আখ্যায়িত করে। এই প্রেক্ষিতে নিজেদের সক্ষমতা জাহির করতে ইরান হরমুজ প্রণালিতে নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করতে থাকে। যদিও ইরানের সামরিক ও বাণিজ্যিক কৌশলে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ এই প্রণালী।
একই সঙ্গে দেশটি পরমাণু চুক্তি থেকে আমেরিকার সরে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ইরান নিজেও ঐ চুক্তির কয়েকটি ধারা মানবে না বলে সময়সীমা বেঁধে দেয়। এতে করেই তেতে উঠে আমেরিকা। এর কয়েকদিন পরেই দেশটির শক্তিশালী একটি ক্যারিয়ার স্ট্যাইক গ্রুপকে পারস্য উপসাগর অভিমুখে প্রেরণ করলে সাম্প্রতিক উত্তেজনা তুঙ্গে উঠে।
বরাবরের মতো দুই দেশের চলমান উত্তেজনার লক্ষ্যস্থল হয়ে উঠে হরমুজ প্রণালী। পারস্য উপসাগরের সঙ্গে পূর্ব ওমান সাগর ও আরব সাগরের সংযোগ স্থাপনকারী হরমুজ প্রণালি একটি সংকীর্ণ সমুদ্রপথ। ইরানের নিয়ন্ত্রণাধীন এই হরমুজ প্রণালি ও তত্সংলগ্ন আন্তর্জাতিক সমুদ্র অঞ্চল হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথ।
অন্যদিকে হরমুজ প্রণালির খুব কাছেই অবস্থিত আরেকটি ক্ষুদ্র জলরাশি আবু মুসা দ্বীপ। এই দ্বীপের মালিকানা সংক্রান্ত ইরান এবং ইউনাইটেড আরব আমিরাতের (ইউএই) সার্বভৌম বিরোধ সবারই জানা। এ সংক্রান্ত ইউএই ও ইরানের মধ্যকার বিরোধ ৯২ সাল থেকে নতুন মাত্রা লাভ করে।
ধীরে ধীরে এই বিরোধ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক দেশগুলোর উসকানির মুখে ক্রমশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে গভীর ক্ষত তৈরি করে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় কয়েক দিন আগে ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কথায়। তিনি আরব আমিরাতকে নতুন ইসরায়েল অভিধায় অভিহিত করেন। উল্লেখ্য, ইরানের বৃহত্ বন্দর আব্বাস ও আইআরজিসি নেভির প্রধান সামরিক ঘাঁটি অবস্থিত এই আবু মুসা দ্বীপে। অন্যদিকে ইরানের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সর্বাধিক ব্যবহূত এই হরমুজ প্রণালী বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, এশিয়ার দুই দেশ চীন ও জাপান নিজেদের সিংহভাগ জ্বালানি আমদানি করে এই পথে। এছাড়াও রপ্তানি ও আমদানি, একই সঙ্গে এই পথের নিয়ন্ত্রক ইরানের জ্বালানির উপর নির্ভরশীল বিশ্বের বহু গুরুত্বপূর্ণ দেশ। যেকারণে এই পথের নৌ-চলাচল নির্বিঘ্ন রাখা সবার কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এর অন্যথা হলে বিপর্যস্ত হবে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সরবরাহ; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ইরান ও আমেরিকা উভয়ই নিজেদের শক্তি ও সক্ষমতা জাহির করতে বেছে নিয়েছে হরমুজ প্রণালীকে। যুদ্ধের মুখে এই পথের জাহাজ চলাচল ইরান বন্ধ করে দিলে সেটি উন্মুক্ত রাখার চ্যালেঞ্জে নেমেছে আমেরিকা। যদিও হরমুজ প্রণালি ঘিরে দুই দেশের দ্বন্দ্ব বহু আগের।
পূর্বে বহুবার দুই দেশ এ সংক্রান্ত বিষয়ে বাকযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। একে অপরকে দোষারোপ করা ছাড়াও বিভিন্ন সংঘাতের মুখোমুখি হয়েছে। সর্বশেষ মাস দুইয়েক আগে আমেরিকার ক্যারিয়ার স্ট্র্যাইক গ্রুপটি পারস্য উপসাগরে পৌঁছলে যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়।
এই অবস্থার মধ্যেই গত মাসে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউনাইটেড আরব আমিরাতের বন্দর ফুজাইমায় চারটি ট্যাংকার চোরাগোপ্তা আক্রমণের শিকার হয়।
এই রেশ কাটতে না কাটতেই গত সপ্তাহে পূর্ব ওমান সাগরে আরো দুইটি বিদেশি ট্যাংকার বিস্ফোরিত হলে মারাত্মক উত্তপ্ত হয়ে উঠে উপসাগরীয় অঞ্চল। দুইটি ঘটনার জন্যই আমেরিকা তাত্ক্ষণিকভাবে ইরানকে অভিযুক্ত করে। এদিকে আমেরিকার সঙ্গে সুর মেলায় আরব দেশগুলোও। পক্ষান্তরে ইরান এই ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ততা সরাসরি অস্বীকার করে। ইরানের দাবির প্রতি সমর্থন জানায় দেশটির প্রধান মিত্র রাশিয়া। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ইরানের বিরুদ্ধে আনীত ভিত্তিহীন অভিযোগ নাকচ করেন।
এদিকে সর্বশেষ ওমান সাগরের ঘটনাটি ঘটেছে এমন একটি সময়ে যখন দীর্ঘ ৪১ বছর পর কোনো জাপানি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিনজো আবে ইরান সফরে ছিলেন। ঐ সময়ের মধ্যে জাপানি মালিকানাধীন ট্যাংকারে আগুন কিছুটা বিস্ময়কর। একই সঙ্গে ইরান এমন কাজটি করেছে সেটি যে কারোর পক্ষেই বিশ্বাস করা কঠিন।
এতদসত্ত্বেও এই ঘটনায় ইরান ও জাপান উভয়ের জন্যই কিছুটা বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করে। এমন প্রেক্ষাপটে পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় ফের উত্তেজনা আবারো যুদ্ধের শঙ্কাই তৈরি করেছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় যে, একমাসের ব্যবধানে দুইটি বিস্ফোরণই ঘটেছে হরমুজ প্রণালির সঙ্গে সংযুক্ত ওমান উপসাগরে।
গত মাসে আমিরাত বন্দরের দুর্ঘটনার পর আরব লীগ ইরানের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় নিন্দা জানায়। ইরানের পালটা প্রতিক্রিয়াটি এখানে প্রণিধানযোগ্য। আরব লীগের জরুরি সম্মেলনের মধ্যেই ইরান উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি করার প্রস্তাব দেয়। এই ঘটনাকে আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের অযাচিত সন্দেহ ও দূরত্ব কমানোর সদিচ্ছা হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
ইরানের এই প্রস্তাবকে রাশিয়া তাত্ক্ষণিকভাবে সমর্থন করে। উভয় দেশ মনে করে, এর মাধ্যমে আঞ্চলিক উত্তেজনা হ্রাস পেতে পারে; কিন্তু আরব দেশগুলো এ ব্যাপারের কোনো সদুত্তর দেয়নি। ফলশ্রুতিতে আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের বিরোধ দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।
নিজেদের শক্তি সক্ষমতা না থাকায় এই দেশগুলো আদৌ কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিয়ে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে পারবে কি না তা নিয়ে আছে বিস্তর সন্দেহ। যে কারণে আরব দেশগুলোকে ইরানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য একাট্টা করার ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ইরান-বিরোধী আরব ঐক্য অনেকটাই জোরদার হয়েছে।
আবু মুসা দ্বীপ ঘিরে আমিরাত ও ইরান দ্বন্দ্বের সম্প্রসারণ ঘটেছে খুব নীরবে। এই ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যের নতুন যুদ্ধ ফ্রন্ট হিসেবে যুক্ত হলে সেটি হবে আমেরিকা ও ইসরায়েলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য।
এরফলে ইরানকে নতুন ফ্রন্টে মনোনিবেশ করতে শ্রম ও সময় ব্যয় করতে হবে। যেটি বৃহত্ভাবে আমেরিকাকে সুবিধা এনে দিবে। একই সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ায় ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে ইরান।
সব মিলিয়ে ওমান উপসাগরের ঘটনাগুলো যুদ্ধের বাস্তবসম্মত ইঙ্গিত হিসেবেই দেখা হচ্ছে। আমরা যদি লক্ষ করি— দেখব এই ঘটনার কয়েকদিন আগেই ইসরায়েল লেবানন সীমান্তে ব্যাপক ভিত্তিক একটি মহড়া সম্পন্ন করেছে। মূলত গোলান সংলগ্ন অধিকৃত ভূমি ‘শেবা’র প্রান্ত ঘেঁষে এই মহড়া মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ পরিকল্পনারই অংশ।
এ ব্যাপারে তেলআবিব কোনো রাখঢাক নেই। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার পর ইরানের অবশিষ্ট মিত্র লেবানন। অন্যদিকে লেবাননের মিলিশিয়া গ্রুপ ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয় যে, ইরান আক্রান্ত হলে হিজবুল্লাহ ইরানের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।
ইরানের এই বাড়তি সুবিধা ভণ্ডুল করতে প্রথমেই হিজবুল্লাহর উপর আলাদাভাবে শক্তি প্রয়োগ করার কৌশল ইসরায়েলের থাকতে পারে। ফলে আপাতত ইরানকে চাপে রেখে হিজবুল্লাহকে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাতের সম্ভাবনা আছে। যে প্রক্রিয়ায় ইরানের সম্মিলিত শক্তির বিভাজন ঘটবে।
পর্যায়ক্রমে ইরানের উপর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। তবে এই ব্যাপারটি আপাতত এতোটা সহজ হবে না। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের শক্তি ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে আগেই। এমন প্রেক্ষাপটে ইরানের সঙ্গে সংঘাত নিয়ে আমেরিকাকে বারবার ভাবতে হবে।
তাই পারস্য উপসাগরের বর্তমান উত্তেজনা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যে ঘটনার চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া অবশ্যই যুদ্ধ।